শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য যেনো হয় তীরের মতো - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য যেনো হয় তীরের মতো

মো. নজরুল ইসলাম |

ইংরেজি Target, aim, focus এই তিনটি শব্দই আমরা বাংলা শব্দের মতো ব্যবহার করে থাকি। লক্ষ্য এবং স্থিরলক্ষ্য/একবিন্দুতে কেন্দ্রীভূতকরণ-এভাবে বললে বরং বুঝতে একটু সময় লাগে, আর ইংরেজি বললে অর্থের গভীরে পৌঁছা সহজ হয়। ইংরেজি Target এবং Aim এর অর্থ খুবই কাছাকাছি তবে Focus একটু আলাদা অর্থ প্রকাশ করে থাকে যদিও বেশিরভাগ সময়ই এক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। স্কুলজীবনে সবাইকে ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ বা Your aim in life মুখস্থ করতে হতো, আর তখন সায়েন্স, আর্টস এবং কমার্সের ছাত্ররাও ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে রচনা লিখতো। কারণ, রচনা বইতে ওটাই লেখা থাকতো, আর্টস বা কমার্সের জন্য আলাদা করে কোনো রচনা বইতে থাকতো না, ব্যতিক্রমধর্মী দু-একটা বইতে অবশ্য শিক্ষক হতে চাওয়ার কথা লেখা থাকতো।

জীবনের লক্ষ্য জিনিসটা কী তা না বুঝেই সবাই পরীক্ষা পাশের জন্য হুবহু মুখস্থ করে উত্তরপত্রে উগরে দিতো, তাতে নম্বর পেতে কোনোই সমস্যা হতো না। কর্মজীবনে এসে একসময় অনুধাবন করা যায় ভুলটা কোথায় ছিলো। ভিশন, মিশন, টার্গেট এই শব্দগুলো তখন খুবই গুরুত্ব পায়। আমাদের সময়ে ছাত্রজীবনে শিক্ষকেরা এই শব্দগুলোর সঙ্গে সেভাবে পরিচয় করে দিতেন না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক ছাড়াও যে ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী, উদ্যোক্তা ইত্যাদি হয়েও এমনকি রাজনীতি করেও যে সাফল্য লাভ করা যায় সে কথা শিক্ষক-অভিভাবক কেউই বলেন না। কোনো একটিকে লক্ষ্য করে সে অনুযায়ীই প্রস্তুতি নিতে হবে এমন কথাও বিশেষভাবে বলেন না। সবাই বলেন, রেজাল্টটা আগে ভালো করো, গোল্ডেন জিপিএ পাও, পরে দেখা যাবে ভাগ্য কোনদিকে নিয়ে যায়।

ভুলটা এখানেই হয়। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময়ই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডারসহ একাধিক টার্গেট মাথায় গিজগিজ করে, আর অনেকগুলো বিষয় একসঙ্গে টার্গেট করতে গিয়ে শিক্ষার্থী সবটাতে ব্যর্থ হয়ে অথৈ জলে হাবুডুবু খায়। মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে বেকার জীবন যাপন করে, বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করে, গার্মেন্টসে কাজ খোঁজে, ছোটোখাটো ব্যবসা শুরু করে অথবা কোনো এনজিওতে যোগ দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে অথবা অসামাজিক কার্যকলাপের জগতে নিজেকে সোপর্দ করে অবশেষে আত্মঘাতী হয়।

উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষার্থীদের একটি লক্ষ্য ঠিক করে লক্ষ্যে অবিচল থাকলে অর্থাৎ সে অনুযায়ী কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে এগিয়ে গেলে লক্ষ্য অর্জন অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। প্রাচীন মনীষী, প্রখ্যাত স্টয়িক দার্শনিক Marcus Aurelius তার বিখ্যাত দর্শন শাস্ত্র  Meditations এ জীবনে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার মন্ত্রে বলেছেন,  You must compose your life action by action, and be satisfied if each action achieves its own end as best can be: and no one can prevent you from that achievement. আর সে জন্য যা প্রথমেই প্রয়োজন তা হলো মনেপ্রাণে একটি টার্গেট বা লক্ষ্যস্থির করা। মনে রাখা জরুরি--টার্গেটটি হতে হবে অবশ্যই লক্ষ্যভেদী।

এ প্রসঙ্গে মহাভারতের একটি গল্প অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষণীয় হতে পারে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রোণাচার্য নামে একজন যুদ্ধবিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় যিনি পাণ্ডব এবং কৌরব উভয়পক্ষকে অস্ত্র পরিচালনা এবং যুদ্ধ কৌশল শিক্ষা দিতেন। একবার প্রশিক্ষণ শেষে তিনি বীরদের ডেকে পরীক্ষা করতে চাইলেন তারা কতোটুকু শিখতে এবং আয়ত্বে আনতে পেরেছেন প্রশিক্ষণের বিষয়। তিনি মাটি দিয়ে একটি মোরগ তৈরি করে বনের মধ্যে উঁচু একটি গাছের মগডালে সেটি বেঁধে দিয়ে বীরদের আদেশ দিলেন একটি মাত্র তীরের আঘাতে মাটির তৈরি ওই মোরগটির গলা ছেদন করতে হবে। একে একে বীরেরা এসে  ধনুকে শর সংযোজন করলে দ্রোণাচার্য জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি মোরগটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছো, মোরগ ছাড়া আর কী কী দেখতে পাচ্ছো? বীরেরা জবাবে বললেন তারা গাছের ডালপালা, পাতা সবই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। অন্যান্য বীরের মতো মহাবীর যুধিষ্ঠিরও জবাব দিলেন মোরগ ছাড়াও তিনি গাছে বেশ কয়েকটি পাখি দেখতে পাচ্ছেন এমনকি ডালের ফাঁক দিয়ে নীল আকাশটিও তার নজরে পড়েছে। দ্রোণাচার্য বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, তোমাদের কারো প্রশিক্ষণই সঠিক হয়নি, আমার বিশ্বাস তোমরা কেউই লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম হবে না।

তার কথাই সত্যি হলো-বীরেরা তীর ছুড়ে সবাই ব্যর্থ হলেন। সবশেষে আসলেন বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন। তিনি তার ধনুকে শর সংযোজন করলে দ্রোণাচার্য জিজ্ঞেস করলেন, হে অর্জুন! তুমি কি মোরগটিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছো, সত্যি করে বল তুমি ঠিক কী দেখতে পাচ্ছো। জবাবে অর্জুন বললেন, মহাশয়, আমি ওই মোরগের গলা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দ্রোণাচার্য মৃদু হেসে বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস অর্জুন তার লক্ষ্য ভেদ করতে সক্ষম ও সফল হবে। হে অর্জুন, তুমি শরাঘাত করো ওই মোরগের গলায়। সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনের গাণ্ডিব ধনুক হতে বিদ্যুৎবেগে তীর ছুটে গেলো এবং মগডালে বাঁধা ওই মোরগের গলা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। গল্প হতে সহজেই অনুমান করা যায় অর্জুনের টার্গেট ছিলো একমাত্র মোরগের গলা অন্যকিছু নয়, কাজেই সাফল্য ছিলো তার জন্য একান্ত অনিবার্য।

শ্রেণিকক্ষে যখন কোনো শিক্ষক পাঠদান করবেন তখন তার একমাত্র লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে বার্তা পৌঁছে দেয়া। আর শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য থাকবে তাদের শ্রবণেন্দ্রিয় শুধুই শিক্ষকের দিকে খোলা রাখা। বাইরে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলেও যেনো শিক্ষার্থীদের কান সেদিকে না যায়। উভয়কেই চোখে চোখ রাখতে হবে। দৃষ্টি অন্যদিকে থাকলে মনের ভাষা পড়া খুবই দুরূহ। একজন মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক শিক্ষানবিসদের সবসময় স্মরণ করিয়ে দেন কীভাবে প্রতিপক্ষের চোখের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হয়। কারণ, আঘাত হানার পূর্ব মুহূর্তে প্রতিপক্ষ টার্গেট করে শরীরের কোন্ অংশে সে আঘাত হানবে। আঘাতকারীর দৃষ্টি ক্ষণিকের জন্য প্রতিপক্ষের সেই অঙ্গের দিকে নিবদ্ধ হয়, কাজেই তার আঘাত প্রতিহত করবার জন্য দ্রুত সেই অংশকে ব্লক করা সম্ভব হয় বা সেই অংশের নিরাপত্তায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যায়। 

একটি বিষধর সাপ যখন কাউকে কাটতে উদ্যত হয় তখন সে চট করে ছোবল দিতে পারে না, তাকে ফণা উঁচিয়ে টার্গেট করতে হয় তবেই ছোবল দিতে পারে। যে সাপটি গর্তে অর্ধেক ঢুকে আছে তার লেজ ধরে শত টানাটানি করলেও সে ছোবল দিতে সক্ষম হয় না। কারণ, টার্গেট করবার সুযোগ সে পায় না। সাপ এবং নেউলের যুদ্ধ আমরা অনেকেই দেখেছি। সাপ বিষধর হওয়া সত্বেও এ যুদ্ধে তাকেই পরাজয় বরণ করতে হয়। কারণ, বেজি সাপের টার্গেটটি খুব সহজেই বুঝতে পারে এবং খুব দ্রুত নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আত্মরক্ষা করে এবং তার নিজের টার্গেট অনুযায়ী পাল্টা আঘাত হানে। এই ইতর প্রাণীর কাছ থেকেও মানবসন্তানদের শেখার অনেককিছুই আছে কীভাবে লক্ষ্য স্থির করতে হয় এবং জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে হয়।  

মানবজীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে নেমে আসে একরাশ বাধা-বিপত্তি। সমস্ত বাধাকে যিনি একসঙ্গে মোকাবিলা করতে চান তিনি ব্যর্থতার কবলে নিপতিত হন। জ্ঞানীমাত্রেই তার অসংখ্য সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে ছোট ছোট ইউনিটে বিভক্ত করেন। তারপর একেকটি ইউনিটকে টার্গেট করে আক্রমণ রচনা করেন এবং ধ্বংস করেন, আর এভাবেই ধাপে ধাপে তিনি প্রতিটি বাধাকেই অতিক্রম করে সফলতার শীর্ষে পৌঁছে যান। সব সাফল্যের মূলে রয়েছে লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দু নির্ধারণ এবং সেই কেন্দ্রবিন্দুতে মনের স্থিরতা (focus and concentration of mind) আনয়ন। অস্থির মন কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। সঠিক বস্তুর ছায়া মনের দর্পনে প্রতিফলিত হয় না। কোরিয়ান বৌদ্ধ সন্ন্যাসী Haemin Sunim তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমের ফসল ‘The things you can see only when you slow down বইতে লিখেছেন, ‘The world moves fast doesn’t mean that we have to.’ 

তিনি আরো লিখেছেন মনের স্থিরতা আনয়ন এবং সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য প্রয়োজন প্রার্থনা বা মেডিটেশন যার মাধ্যমে প্রকৃতি নিজেই এগিয়ে আসে প্রার্থনাকারীর কাছে সমাধান দেবার জন্য। তিনি বলেছেন, If you don’t know how to solve a problem in your life, give prayer a try. As you bring your attention inward and sincerely seek an answer, something sacred within you unlocks the door of inner wisdom. If you are desperately looking to meet someone special, send your prayer out to the universe. The universe is an amazing matchmaker. 

বিক্ষিপ্ত মনকে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারলেই প্রকৃতির তত্ত্বাবধানে জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, মানসচক্ষু খুলে যায়, অজানা জগত উপস্থিত হয় ব্রেনের কোষে কোষে। ধ্যান বা মেডিটেশনকারী একপর্যায়ে বোদ্ধা হয়ে ওঠেন যার প্রমাণ রেখে গেছেন গৌতম বুদ্ধ এবং হযরত মুহম্মদ (সা.) এর মতো মহামানবেরা যাঁরা বোধিদ্রুম এবং হেরাগুহায় ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঋষিকবি, গুরুদেব রবিঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বজরায় চেপে নদীর মাঝখানে গিয়ে নোঙর করে ধ্যানমগ্ন থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টার। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় জ্ঞানীরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে নিজেকে একাকী রাখতেন নিবিড় ধ্যানে বা গবেষণায় আর এভাবেই তারা পেয়েছেন জ্ঞানজগতের সন্ধান যাদের লব্ধ জ্ঞানে ঋদ্ধ হয়েছে মানবজাতি। যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, তবে সাফল্য ধরা দিতে বাধ্য। 

লেখক: যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়  

 

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033969879150391