শিক্ষার্থীরাই পথ দেখায় - Dainikshiksha

শিক্ষার্থীরাই পথ দেখায়

ড. শেখ আবদুস সালাম |

একটানা দুই টার্ম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে একটি দুর্ঘটনায় কলেজের দুই ছাত্রছাত্রীর মৃত্যু এভাবে দাবানলের মতো আন্দোলন-বিক্ষোভ তৈরি করে এবং সামান্য সময়ের মধ্যে এত তীব্র হয়ে উঠতে পারে সম্ভবত আমরা অনেকেই তা ভাবতে পারিনি। আশা করছি, ছাত্রদের এই আন্দোলন এতদিন ধরে চলে আসা সড়ক নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শুভ কিছু বয়ে নিয়ে আসবে। 

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর থেকে বাংলাদেশে বহু ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে কিছু ঘটনা আছে, যা দেশ এবং দেশের মানুষের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ ও ভাগ্য বদলের বাঁক পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। যেমন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা এবং ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলন (ফলে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান) ইত্যাদি সবকিছুই এ দেশের রাজনীতির গতি নির্ধারণ ও তা পরিবর্তনের এক একটি মাইলফলক। ইতিহাসের দিকে তাকালে নির্দি্বধায় বলতে হবে, এসব প্রত্যেকটি ঘটনার অনুঘটক কিংবা নায়ক ছিল এ দেশের ছাত্ররা। তারাই ছিল এসব আন্দোলনের মূল শক্তি। আর ছাত্ররা যখন এসবে মূলশক্তি হিসেবে সম্পৃক্ত হয়েছিল, তখনই কেবল আন্দোলন থেকে সৃষ্ট ফসল এ দেশের মানুষ এবং আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঘরে তুলতে পেরেছিল। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও ছাত্রসমাজ বেশ কিছু পথ ঘটনা নিয়ে প্রদর্শকের মতো উদ্যোগ নিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে বন্যার পর আমন ধানের পরে বীজতলা তৈরি করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ, ছাত্র ব্রিগেড তৈরি করে পাটের গুদাম পাহারা দেওয়া, জেলায় জেলায় চোরাচালান রোধে উদ্যোগ নেওয়া, বন্যার সময় রুটি বানানো কর্মসূচি চালু এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার-রুটি প্রভৃতি সংগ্রহ করে বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা এমন বহু উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে ছাত্রদের নেতৃত্বদান এবং অংশগ্রহণ ছিল অনন্য। বহু ভুল-ত্রুটি এবং সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও মানবিকতা রক্ষা এবং অন্যায়-অন্যায্যতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের মজ্জাগত এবং তা তাদের স্বভাবের মধ্যেই মিশে রয়েছে। 

আমরা অবাক হয়ে এবারের ছাত্রদের এই আন্দোলনের কিছু 'সৌন্দর্য' লক্ষ্য করেছি। সামান্য কিছু ভাংচুর এবং দু'একটি বাসে অগ্নিসংযোগ (যা আন্দোলন-বিক্ষোভের তীব্রতার তুলনায় অনেক কম; তবে এটিও অকাম্য এবং নিন্দনীয়) ছাড়া হাজার হাজার ছেলেমেয়ে রাস্তায় নেমে এসে আমাদের এক নতুন উপলব্ধির সন্ধান পাইয়ে দিয়েছে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ছাত্ররা ছাত্র নামধারী কিছু কিছু নাশকতা সৃষ্টিকারীদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। এসব কিশোর-কিশোরীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চালকদের লাইসেন্স এবং যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করেছে। কোথাও ব্যত্যয় দেখলে তাদের পুলিশের হাতে সমর্পণ করেছে। লাইসেন্স না থাকলে রাস্তায় ওই গাড়ি চালানো তারা তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দিয়েছে। উত্তরায় পুলিশ ভর্তি একটি বাসের চালকের লাইসেন্স ছিল না। বাসটির গায়ে শিক্ষার্থীরা লিখে দিয়েছে 'লাইসেন্স নেই'। খবরের কাগজে দেখেছি, আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী (একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা) তোফায়েল আহমেদের গাড়ি রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে যচ্ছিল। এই শিক্ষার্থীরা সেই গাড়িও ঘুরিয়ে দিয়েছে। অনেক মন্ত্রী এবং বড় বড় আমলাদের গাড়ির অনিয়ম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে; আইনগতভাবে প্রতিবিধানের উদ্যোগ নিয়েছে। 

একটি খবরে দেখেছি, মিরপুর সড়কে ঝাড়ূ হাতে তারা রাস্তায় পড়ে থাকা কাচ পরিস্কার করছে। এই শিক্ষার্থীরা তাদের দাবির সপক্ষে ঢাকার কিছু কিছু জায়গায় অবরোধ তৈরি করেছিল। কিন্তু যেখান দিয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স, বিদেশগামী যাত্রী, শিক্ষার্থীদের বহনকারী গাড়ি, জরুরি সেবাদানকারী যানবাহন যেতে দেখেছে, তা তারা নিজেরাই আবার পাহারা দিয়ে পার করে দিয়েছে, লাইন মেনে গাড়ি চালাতে অনেককে তারা বাধ্য করেছে। তারা এ সময় প্ল্যাকার্ড বহন করেছে 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। সাধারণত আন্দোলন-বিক্ষোভ চলাকালে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে প্রতিপক্ষ ভাবে। কিন্তু এই আন্দোলনে দেখা গেছে, তারা পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছে, তাদের হাতে ফুল তুলে দিয়েছে; আবার পুলিশের অনিয়ম ধরতেও তারা পিছপা হয়নি। পুলিশের কাছে তারা প্রশ্ন রেখেছে- আইন এবং নিয়ম রক্ষা করতে না পারলে তাদের কাজ কী? রাস্তায় সমবেত হয়ে তারা স্লোগান দিয়েছে- 'বিচার চাইতে এসেছি, ভাঙচুর করতে নয়।'

সবকিছু দেখে এবং গণমাধ্যমের খবরাখবর জেনে ছাত্রদের আন্দোলনে এসব নতুন উপাদান এবং তাদের এই 'আন্দোলন ও শিক্ষাদান' কর্মকাণ্ড আমাদের মধ্যে এক অন্যরকম আশাবাদের জন্ম দিচ্ছে। আন্দোলনের যুক্তি এবং ইতিবাচক ডেমোনেস্ট্রেশন যে কত শক্তিশালী হতে পারে, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সরকারপ্রধানের ইতিমধ্যে নেওয়া কিছু উদ্যোগে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে 'বাঘা' মন্ত্রীদের বৈঠকে বসা, সড়ক মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সড়ক আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া, ধমকের পরিবর্তে মন্ত্রীদের আচরণে এবং বচনে সংযত হওয়া ইত্যাদি আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে যে, এই কিশোর-তরুণ ছাত্রছাত্রীরাই পারে আমাদের পথ দেখাতে; বিনয়, বুদ্ধিমত্তা এবং শুভ কর্মকাণ্ডের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ক্ষমতার মসনদে বসে থাকা ক্ষমতাধরদের ঔদ্ধত্যের রশিকে টেনে খানিকটা হলেও নামিয়ে আনা আমাদের এই কিশোর-তরুণ ছাত্রছাত্রীদের পক্ষেই সম্ভব। আন্দোলনের ন্যায্যতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এখনও পর্যন্ত সরকারের নেওয়া উদ্যোগ বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞাপূর্ণ পদক্ষেপ আমাদের আশাবাদীই করছে। ধমক এবং দমনের পথ পরিহার করে অর্থাৎ জোরের যুক্তি না দেখিয়ে যুক্তির জোরের পথে হাঁটলে দেশের জন্য শুভই হবে। সব 'শুভ'-র জয় হোক। 

লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: সমকাল

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029838085174561