মানুষ তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে শিক্ষা অর্জনের জন্য। পরিণামে সমাজে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। একাডেমিকভাবে শিক্ষা অর্জন করলেও কতজন বিবেক বিবেচিত শিক্ষা অর্জন করে? বর্তমান সমাজে শিক্ষিত মানুষের অভাব নেই কিন্তু শিক্ষিত বিবেকের বড্ড অভাব। আমরা আমাদের শিক্ষাকে সার্টিফিকেট ও চাকরির মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। যার ফলে সমাজে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও শিক্ষিত বিবেকের সংখ্যা অতি নগণ্য। বর্তমান সমাজে যারা দুর্নীতি করে তাদের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যাই বেশি। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো অভাব নেই কিন্তু তাদের একটাই অভাব শিক্ষিত বিবেক। দুর্নীতি দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর জেনেও তারা দুর্নীতি করে কারণ তারা তাদের শিক্ষার সঙ্গে বিবেককে কাজে লাগায় না। যার কারণে সমাজে দুর্নীতি ক্রমাগত বেড়ে চলছে। শিক্ষা আমাদের সভ্য ও মার্জিত হতে শিখায়। আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি ঠিক কিন্তু সেই শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করি না। আর বাস্তবায়ন না করার ফলে আমরা মাঝেমধ্যে অসভ্য বর্বর হয়ে উঠি এবং এমন ঘৃণ্য অপরাধ করে বসি তখন আমাদের মানুষ ভাবতেও অবাক লাগে। সোমবার (২১ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় না, মানুষ হতে শিক্ষিত বিবেক লাগে। আর শিক্ষিত বিবেক তৈরি হয় শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কিন্তু আমরা অধিকাংশই শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা তো দূরের কথা চিন্তাই করি না। শিক্ষাকে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখি। এটাকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়নের প্রয়োজন বোধ করি না। প্রতিটি মানুষই বিবেকসম্পন্ন কেউ তার বিবেককে পরিচর্যার মাধ্যমে জাগ্রত রাখে, আবার কেউ তার বিবেককে অবহেলা, অবজ্ঞা এবং উদাসীনতার মাধ্যমে দাবিয়ে রাখে। বিবেককে ক্রমাগত অবহেলার মাধ্যমে বিবেকের অপমৃত্যু ঘটে এবং মানুষ অমানুষে পরিণত হয়। একজন বিবেকসম্পন্ন মানুষ পারে তার শিক্ষাকে মূল্যায়নের মাধ্যমে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ, জিঘাংসা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ-লালসা, অন্যায় থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে সমাজ, দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে। পক্ষান্তরে একজন বিবেকহীন মানুষ নিজ সহজাত প্রবৃত্তি ও অন্যায়ের কাছে শিক্ষা ও বিবেককে বিসর্জন দিয়ে সমাজ, দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের পথে ধাবিত করে। মানুষ ও প্রাণীর মাঝে পার্থক্য হলো মানুষের চিন্তাভাবনা (বিবেক) করার শক্তি আছে আর প্রাণীর চিন্তাভাবনা করার শক্তি নেই। কিন্তু যখন আমাদের চিন্তাভাবনা করার শক্তি লোপ পায় তখন আমরা প্রাণীর মতো আচরণ করি। প্রাণীর যেমন তার কৃতকর্ম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা ধারণা থাকে না তেমন আমাদেরও আমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা ধারণা থাকে না। ফলে তখন শিক্ষা-দীক্ষা কোনো কাজে আসে না। একমাত্র বিবেক ও বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই পারে একটি সমাজকে সকল প্রকার অন্যায়-অনাচারমুক্ত করে দেশ ও জাতিকে সুসভ্য করে গড়ে তুলতে। সমাজে আজ কোনো সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক বন্ধন নেই কিন্তু কেন? সমাজের সর্বস্তর থেকে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান, পরশ্রীমুখরতা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে মানছে না। ছোটো বড়োকে সম্মান করছে না, বড়ো ছোটোকে স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারছে না। জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষক লাঞ্ছিত হচ্ছেন স্বীয় গুণধর ছাত্রের দ্বারা। ছাত্র তার ছাত্রবন্ধু দ্বারা নিহত হচ্ছে।
সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মানুষের জীবনের মূল্য এখন যে কোনো বস্তু থেকে অতি নগণ্য। স্বাধীন দেশের অধিবাসীরা স্বাধীনভাবে নির্ভয়ে মুক্ত বাতাসে চলাফেরা করতে পারছে না। কিসের ভয় যেন তাড়া করে ফিরে। চারদিকে অবক্ষয় আর অবক্ষয়। ব্যক্তি ও জাতীয় চরিত্রের চরম অধঃপতন, পারিবারিক ও সামাজিক সু্শৃঙ্খল অবকাঠামোর ভাঙন। বলা যায়, ব্যক্তি সামাজিক, পারিবারিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন এক মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত। বিবেক রক্ষার জন্য নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। অসুস্থ বিবেককে সুস্থ করে গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। একমাত্র নৈতিক শিক্ষাই পারে ব্যক্তির ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করতে।
সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর অরাজকতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নৈরাজ্য দূর করে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশকে স্বাভাবিক করে। এ সব প্রতিষ্ঠান থেকেই জাতির বিবেকসম্পন্ন কর্ণধার তৈরির প্রচেষ্টা করতে হবে। যারা দেশকে বিশ্বের বুকে পরিচিত লাভের সহায়তা করবে। কারণ বিবেকই পারে মানুষের মানবীয় মূল্যবোধ ও দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে।
মো. সাব্বির আহমেদ : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।