বিজয়ের ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। দেশ নানা চ্যালেঞ্জের মাঝেও এগিয়ে চলছে। অথচ আগামী প্রজন্ম শিশুরা কতটুকু সমৃদ্ধি লাভ করেছে, তা আজ বিজয়ের লগ্নে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। তাদের নিয়ে যথাযথ ভাবনা কার্যকর হলে আমরা পাবো সুখী-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের বাংলাদেশ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের আবেগজনিত হৃদয়ের মর্মস্পর্শী লাইনটি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। আমার সোনার বাংলাদেশকে ভালবাসার মাঝে সবার আগে শিশুদের যথাযথ ভালবাসার কথা ভাবতে হবে।
প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষায় এ বছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বহিষ্কৃত হয়েছে। আমাদের শিশুদের বহিষ্কার তাদের প্রতি কেমন ভালবাসা? এ প্রসঙ্গে একটি গানের লাইন মনের মাঝে ঘুরে ফিরে আসছে। লাইনটি হল, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কী আছে’? আমাদের কতিপয় শিক্ষক, কর্মকর্তা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়েই এ হৃদয়হীনরা রয়েছেন।
উন্নত বিশ্বে শিশুদের পরীক্ষা নেই। শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশ সাধনের জন্য সেখানে জ্ঞান অর্জন মূল লক্ষ্য। অথচ আমাদের দেশের অভিভাবকসহ প্রায় অনেকের লক্ষ্য হাতুড়ে মার্কা পরীক্ষার মাধ্যমে বেশি নম্বর বা জিপিএ-৫ প্রাপ্তি। শিক্ষার্থী বড় হয়ে নির্দিষ্ট বইয়ের গুটি কয়েক প্রশ্নের জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। যার ফলে বড় বড় পাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা তো দূরে থাক, পাস নম্বরও অর্জন করতে পারে না। সীমাবদ্ধ জ্ঞানের মাঝে বড় হয়ে তাদের হোচট খেতে হয়। যা অনেকটা ওপর দিয়ে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট প্রবাদের মত।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষার্থীর জ্ঞান অনেকটা বাবু ও মাঝি কবিতার মতো অনেকটা ষোল আনাই মিছে। প্রয়াত নায়ক বুলবুল আহমেদ, সালমান শাহ ও নায়িকা শাবনুরের সাথে কিছুটা সময় পরিচালক মোহাম্মদ হান্নানের বিক্ষোভ ছবিতে শিক্ষকের চরিত্রে কাজ করার গানের স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। গানঠি ছিল, ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়, এখানে সভ্যতারই ফুল ফুটানো হয়। এখানে জ্ঞানের আলোর মশাল জ্বেলে হয় যে সূর্যোদয়’।
বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থা জ্ঞানের আলোকে প্রাধান্য না দিয়ে পরীক্ষায় বড় বড় পাসকে মূখ্য হিসেবে দেখা হয়। শিশুর ওপর শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ শিশুদের ওপর পরীক্ষায় মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নিরবে দেখছে। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে শিশুদের পরীক্ষায় বহিস্কার করে শুধু মানসিক নির্যাতন নয়, পাপও বটে। মহামান্য আদালত নির্দেশনা দিবে, তারপর বহিস্কৃত পরীক্ষার্থীদের পুনরায় পরীক্ষা নিবে, এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
সবকিছুর নির্দেশনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও হাইকোর্ট দিবে, এটা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণের কাম্য নয়। বড় বড় জ্ঞানবিহীন পাসের জন্য অভিভাবক শিক্ষক, কর্মকর্তা, এমনকি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিছক বাহবা পাওয়ার জন্যে বসে আছেন। প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি ও ইবতেদায়ি শিক্ষকদের এমপিও বিষয়টি পরীক্ষা পাসের ওপর নির্ভর করবে বিধায় নানা স্থানে শিক্ষকেরা হুমড়ি খেয়ে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অনৈতিক কাজে অভ্যস্ত করছে। কতিপয় বেসরকারি কিন্ডার গার্টেন স্কুলও রেজাল্টের চমক দিয়ে অভিভাবকদের আকৃষ্ট করার জন্য পরীক্ষায় শিক্ষার্থী, অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছেন।
নানাভাবে আমরা শিশুদের অনৈতিক কাজে অভ্যস্ত করে সুশিক্ষা থেকে অনৈতিক শিক্ষার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এ জন্য কি আমরা আগামী প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের দায়ী করে বহিষ্কারের মত শাস্তি দিব? শিক্ষকদের এ অনৈতিক কাজের জন্য অবশ্যই কঠিন শাস্তি দিতে হবে। কতিপয় সরকারি, বেসরকারি স্কুল তাদের শিক্ষার্থীদের নিজ কেন্দ্রে রেখে পরীক্ষায় হলে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাজার বসানোর ঘটনাও ঘটে চলছে। এ বিষয় ডেমরা থানা শিক্ষক সমিতি ও থানার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে আবেদন কোন ইতিবাচক ফল লাভ করতে পারেনি। বিষয়টি সম্পর্কে প্রবীণ শিক্ষক নেতা ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি এম এ ছিদ্দিক মিয়া বলেন, ‘নিজ কেন্দ্রে পরীক্ষা বন্ধে ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছরই সরকারি ও কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা ডেমরার থানা শিক্ষা অফিসার, ঢাকার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, ঢাকার জেলা প্রশাসক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেছি। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে আজ হতাশ’।
প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় শিশুদের অনৈতিক কাজ বন্ধের সব দোষ কী শিক্ষকদের? বাকি সবাই কি ধোয়া তুলশি পাতা। প্রাথমিকের বদলি, ইবতেদায়ির এমপিও নীতিমালা থেকে ফলের বিষয়টি বিলুপ্ত করা আজ ভেবে দেখার সময় এসেছে। মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের জন্য অপেক্ষা না করে শিগগিরই বহিষ্কৃতদের পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হোক। আইনজ্ঞের প্রতি আহ্বান জানাবো, যারা শিশুদের বহিষ্কারের মত জঘন্য আদেশ দিয়ে মানসিক শাস্তি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করা কথা ভাবতে হবে। শিশুবান্ধব সময়সূচি, শিশুর ওপর পাঠ্যবইয়ের বাইরে নোট গাইডসহ অমানবিক যন্ত্রণা দূর করার হোক এ বিজয়ের মাসের অঙ্গীকার।
গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের প্রতি আহ্বান ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগে এ বাংলাদেশে বিজয়ের মাসে শিশুকে যন্ত্রণামুক্ত করুন। বিজয়ের মাসে এ শুভলগ্নে শিশুদের শারিরীক ও মানসিক যন্ত্রণামুক্ত হোক সকলের ভাবনা।
লেখক: মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।