সঙ্কটমুক্ত হলো না নতুন পাঠ্যবই - দৈনিকশিক্ষা

সঙ্কটমুক্ত হলো না নতুন পাঠ্যবই

বিভাষ বাড়ৈ |

পাঠ্যবইয়ে রুচিহীন, অযৌক্তিক ও উদ্ভট ছবি ও বিষয়যুক্ত করায় গত এক বছর ধরে ব্যাপক বিতর্ক চললেও সঙ্কটমুক্ত হলো না নতুন পাঠ্যবই। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের বদৌলতে আগামী বছরের পাঠ্যবইয়েও রয়ে গেছে ‘ছাগল’ ও ‘ওড়না’ সঙ্কট। বিতর্কের মুখে শিশুদের বইয়ে ছাগলকে গাছের ওপর থেকে নিচে নামালেও বই থেকে নামানো হলো না ‘ওড়না’। আমগাছের ওপর ছাগলের ছবি যুক্ত করে বিতর্কের মুখে পড়ায় নতুন বইয়ে সেই ছবি বাদ দেয়া হয়েছে। তবে ‘ছাগল’র মায়া ত্যাগ করতে না পারায় অন্তত ৬টি স্থানে ছাগলের ছবি যুক্ত আছে। অন্যদিকে প্রথম শ্রেণী থেকে ‘ও’ তে ওড়না চাই সরিয়ে ‘ ও তে ওড়না’ যুক্ত করা হয়েছে প্রাক প্রাথমিকের বইয়ে!

কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের ইচ্ছাকৃত কর্মকা-ের ফল হচ্ছে রুচিহীন, অযৌক্তিক ও উদ্ভট ছবি ও বিষয় যুক্ত পাঠ্যবই। তাদের কারণেই প্রাথমিকের বই নিয়ে এত বিতর্কের পরেও বিতর্কিত সেই বিষয় বাদ দেয়া হয়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানসহ কর্তাব্যক্তিরা ঘটনার দায় স্বীকার করে বলছেন, ‘ও’ বর্ণ দিয়ে আর কোন সহজ শব্দ নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত পরিমার্জন কমিটিও ‘ওড়না’ শব্দ বাদ দেয়ার কথা বলেনি। তবে আবারও বিতর্কের মুখে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কাও আছে কর্মকর্তাদের।

এদিকে গত এক বছর ধরে হেফাজতসহ উগ্র মৌলবাদীদের আবদার মেনে পাঠ্যবইয়ে যে সাম্প্রদায়ীকিকরণ হয়েছে তার কোন পরিবর্তন হয়নি। উগ্রবাদীদের কথা অনুসারে হিন্দুসহ প্রগতিশীল যেসব লেখকদের লেখা বাদ দেয়া হয়েছিল তা আর ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করা হয়নি। যাকে মৌলবাদীদের সঙ্গে আপোসের ফল বলছেন প্রগতিশীলরা। যদিও বহু আগেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় বই সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করার কোন উদ্যোগ নেই। তবে পাঠ্যবইকে রুচিহীন, অযৌক্তিক ও উদ্ভট ছবি ও বিষয় যুক্ত করায় যে বিতর্ক তার অবসান ঘটানো হবে আগামী বছরের বইয়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা কতটুকু সম্ভব হয়েছে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে।

নতুন বই পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রথম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যবই ‘আমার বাংলা বই’-এ আম গাছে ওঠা ছাগলটি এবার নেমেছে। নেমে দাঁড়িয়েছে গাছের নিচে। ২০১৭ সালের (চলতি শিক্ষাবর্ষ) প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে আম গাছে ওঠা ছাগলের ছবি যুক্ত করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল সরকার। এব অবস্থায় ২০১৮ সালের বইয়ে কিছুটা কৌশলগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। এবার ছবিতে দেখানো হয়েছে ছাগল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আগামী ১ জানুয়ারি ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসবের’ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেবে সরকার। বইটিতে দেখা গেছে, ৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘আ’ বর্ণ দিয়ে শব্দ তৈরি শেখাতে ‘আম খাই’ লিখে গাছের নিচে একটি ছাগল দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। যদিও এ বছরের বইয়ে ছাগলটিকে গাছে ওঠা অবস্থায় দেখানো হয়েছিল।

আগামী বছরের জন্য প্রস্তুত করা এ পাঠ্যবইয়ের ৩২ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘র’ বর্ণ শেখাতে ‘রং চিনি’ লিখে রঙধনুর ছবি যুক্ত করা হয়েছে। যদিও এ বছরের বইটিতে ‘র’ বর্ণ শেখাতে ‘রথ টানি’ লিখে রথ টানছে এমন ছবি দেয়া হয়েছিল। বইয়ের ৭১ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মুক্তিযোদ্ধাদের কথা’ প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি পরিবর্তন করে স্পষ্ট ছবি দেয়া হয়েছে। এ বছরের বইয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি হাতে আঁকা ছবি ছিল।

এদিকে পাঠ্যবইয়ে বিতর্কিত ওড়না শব্দটি আবারো যুক্ত করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর বাংলা বই থেকে মুছে ফেলে এবার সেটি কোমলমতি প্রাক প্রাথমিকের শিশুদের ‘আমার বই’ এর বর্ণমালায় যুক্ত করা হয়েছে। এটি নিয়ে আবারো সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকের বাংলা বইটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘আমার বই’ নামক শিশু শিক্ষার্থীদের বাংলা বইয়ের বর্ণমালা শেখাতে ৩৬ পৃষ্ঠায় ‘ও-তে ওড়না’ বলা হয়েছে। ছবি হিসেবে একটি মেয়ে শিশুর গায়ে ওড়না দেয়া হয়েছে।

২০১৭ শিক্ষা বছরের প্রথম শ্রেণীর ‘আমার বাংলা’ বইয়ে বর্ণ পরিচয়ে (পাঠ-৭) ‘অ’ শেখাতে গিয়ে অজ হিসেবে ছাগলের ছবি ব্যবহার করা হয়। একই বইয়ের পাঠ-১২ তে ‘ও তে ওড়না চাই’ বলা আছে। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শিক্ষাবিদরাও প্রতিবাদে নানা কর্মসূচী পালন করেন। বলা হয়েছিল, রুচিহীন ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা থেকে মেয়েদের ওড়না টেনে আনা হয়েছে। বহু শব্দ থাকতেও ওড়না টেনে আনা উদ্দেশ্যমূলক। প্রথম শ্রেণীর একজন শিশুর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার সঙ্গে ‘ও’তে ওড়না শেখানোর বিষয়টি সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেও প্রতিবাদ ওঠে। তাছাড়া ছেলেশিশুরাও বইটি পড়ে। নানা সমালোচনার মুখে প্রথম শ্রেণীর বইটি পরিমার্জন করে ‘ও-তে ওজন’ শব্দ দেয়া হয়। ছবি দেয়া হয় ওজন পরিমাপক যন্ত্রের। প্রথম শ্রেণীর বই থেকে তুলে দেয়ার পরে প্রাক-প্রাথমিকের বইয়ে ‘ওড়না’ শব্দ যুক্ত করায় প্রশ্ন উঠেছে এবার।

ইতোমধ্যেই শিক্ষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আপত্তি উঠেছে। শিক্ষকরা বলছেন, ও-তে ‘ওলকপি’, ‘ওজন’, ‘ওলি’, ‘ওজু’সহ নানা সহজ শব্দ রয়েছে। একটি পরিচিত বা সহজে পরিচয় করানো যায় এমন শব্দ ব্যবহার করা যেত। তাহলে এ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উঠত না। এত বিতর্কের পরেও কেন আবার একই কাজ করতে হলো সেই প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষকরা। তারা অভিযোগ তুলেছেন, এসবের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তারা শিশুদের মনে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ঢুকিয়ে দেয়াকেই যৌক্তিক মনে করছেন। গত বছর অনেক সমালোচনার পরও এমন বিতর্কিত বিষয় শিশুদের বইয়ে রাখা হচ্ছে। এর অর্থই হলো, যারা এই কাজটি করছেন তারা একই মানোবৃত্তির। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট শাখাকে এর জন্য দায়ী করছেন শিক্ষকরা।

বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার প্রসঙ্গে টেনে বলেছেন, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ উগ্রবাদী সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। শিশু শ্রেণী থেকেই একটি শিশুর মনে একটি সংস্কৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। কিন্তু সেই প্রাক-প্রাথমিকেই যদি এমন বিতর্কিত বিষয় যুক্ত রাখা হয়, তাহলে ওই শিশুরা এক সময় উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকবে, এটাই স্বাভাবিক।

জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, বিশেষজ্ঞরা বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে এনসিটিবিতে জমা দেয়। এরপর সম্পাদনা শাখার কর্মকর্তারা যাচাই বাছাই করে ছাপার জন্য প্রেসে পাঠায়। প্রথম শ্রেণীর বই থেকে ‘ও-তে ওড়না’ শব্দ তুলে দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগে ছিল ‘ও তে ওড়না চাই। এবার তা নয়। এবার ‘ও তে ওড়না’ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এত বিতর্কের পরেও ওড়না কেন আবার রাখতে হলো? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ও’ বর্ণ দিয়ে আর কোন সহজ শব্দ নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত পরিমার্জন কমিটিও ‘ওড়না’ শব্দ বাদ দেয়ার কথা বলেনি। তারা যেভাবে বলেছে সেভাবেই হয়েছে।

তবে আবারও বিতর্কের মুখে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কাও আছে কর্মকর্তাদের। এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক ড. মিয়া এনামুল হক সিদ্দিকী (রতন সিদ্দিকী) বলছিলেন, এবার প্রাক প্রাথমিকের বইয়ে ওড়না আছে। তবে আগে প্রথম শ্রেণীতে ছিল ‘ও তে ওড়না চাই’। এবার ‘ও তে ওড়না’ বলা হয়েছে। কিন্তু এত বিতর্কের পরেও আবার কেন ওড়না রাখতে হলো? এমন প্রশ্নে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তবে বলেন, হ্যাঁ যদি কেউ বিতর্ক তুলতে চায় এবারও করতে পারে।

 

সৌজন্যে: জনকণ্ঠ

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031387805938721