এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। ফল প্রকাশের পর শুরু হবে ভর্তিযুদ্ধ। শিক্ষার্থীদের ছুটতে হবে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতি বহাল থাকলে এর বিকল্প নেই। কিন্তু সমন্বিত কিংবা গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার কোনো সুখবর এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে নেই। কয়েক বছর ধরে অনেক আলোচনা, অনুরোধ ও নির্দেশনার পরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একত্র হয়ে কোনো ফর্মুলা বের করতে সক্ষম হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি—সবাই মিলে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আজও পারেনি। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধ ও নির্দেশনাও কোনো কাজ দেয়নি। আমরা সম্ভবত সমন্বিত কিংবা গুচ্ছ পদ্ধতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছি না। মঙ্গলবার (২১ মে) দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ড. নিয়াজ আহম্মেদ।
আমরা পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করছি; কিন্তু কোমলমতি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আর্থিক ও মানসিক কষ্টের কথা একদম ভাবছি না। ফলে কোনো সীমাবদ্ধতা থাকলে তাকে উতরে একটি জায়গায় পৌঁছতে যেন কোথায় গলদ। বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, যখন দেশে ১০-১২টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তখন এমন পদ্ধতির কথা আমাদের মাথায় আসেনি, এমনকি এর প্রয়োজনও আমরা অনুভব করিনি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০-এর কাছাকাছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহর অতিক্রম করে জেলায় জেলায় পৌঁছেছে এবং সরকারের লক্ষ্য জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা। আমাদের আজ হোক, কাল হোক, সমন্বিত পদ্ধতিতেই যেতে হবে। কেননা এর কোনো বিকল্প নেই।
ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগে বেশ কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশেষায়িত দিক বিবেচনা করে চারটি ক্যাটাগরিতে এনে গুচ্ছ পদ্ধতির সুপারিশ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসনের দোহাই দিয়ে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের কোনো উদ্যোগ আজও গ্রহণ করেনি। ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কষ্ট ও ভোগান্তি আজও রয়ে গেছে। সমন্বিত ও গুচ্ছ পদ্ধতির বিপক্ষে অনেক যুক্তি আছে। আছে পক্ষেও অনেক যুক্তি। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি না বলে আমরা সীমাবদ্ধতার কথা বলতে পারি, যা মোকাবেলা করতে পারলে এ পদ্ধতির মাধ্যমে সুফল পেতে পারি। প্রথমত, মনে করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করানো হয়। এ কথা সত্য; কিন্তু সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাটাগরি বিবেচনায় পাঠদানের বিষয় প্রায় একই রকম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং দেশ ও বিদেশের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে বিষয় নির্বাচন করে। এ বছর একটি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো একটি নতুন বিষয় চালু করলে আগামী বছর অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সেই বিষয়টিকে বিবেচনায় আনে। শিক্ষার্থীরা চায় নতুন নতুন জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতে। ফলে বিষয় কোনো বড় বিবেচ্য নয়। আর আমরা শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় মূল্যায়ন করি তার এইচএসসি পরীক্ষার পঠিত বিষয়গুলো দিয়ে। সেখানে বাংলা-ইংরেজি বাদে বিভিন্ন বিশেষায়িত বিষয় থাকে। কয়েকটি উপবিভাগ থাকে, যার ওপর ভিত্তি করে কেউ মৌলিক, ফলিত, প্রযুক্তি, কৃষি কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হয়।
দ্বিতীয়ত, আরেকটি বিষয় মনে করা হয়, বিভাগীয় ও জেলা শহরে পরীক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থী ঢাকাসহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে। এখানে ভর্তি পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু একই পদ্ধতিতে পরীক্ষার মাধ্যমে মেডিক্যালে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারলে আমাদের সমস্যা কোথায়! মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা একই দিনে সারা দেশে অনুষ্ঠিত হয়। এমন সন্দেহ হলে তারও সমাধান আছে। আমরা শুধু ঢাকা শহর এবং বড় বড় বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারি। যদি গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হয়, সে ক্ষেত্রে খোদ ঢাকা শহরে স্থান সংকুলানের কোনো সমস্যা হবে না। অর্থাৎ রাজধানীতেই ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। ইউজিসি কর্তৃক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এমন আয়োজন করা অসম্ভব নয়। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের পারিতোষিকের বিষয়টি সামনে আসে। আমি মনে করি, পারিতোষিকই মূল বিষয় নয়। আমার কাছে মনে হয়, পারিতোষিকের তুলনায় বড় বিষয় স্বায়ত্তশাসনের নামে নিজেদের মধ্যে ইগো, যে জায়গা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না। চতুর্থত, নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনে অনেক ঝুঁকি থাকবে। যেমন—প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও প্রেরণের ঝুঁকি। এমন ঝুঁকি প্রতিনিয়ত অন্যান্য পরীক্ষায় থাকছে। ঝুঁকি নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত এবং আমরা নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, সেহেতু সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। নতুন পথ আমাদেরই বের করতে হবে। শুরুটা কাউকে না কাউকে করতে হবে। ধরুন, বর্তমানে যেসব প্রযুক্তি ও প্রকৌশল কিংবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তারা একত্র হয়ে গুচ্ছ পদ্ধতির মাধ্যমে একটি পরীক্ষা নিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা একত্র হয়ে যৌথ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমবে। এভাবে যদি কেউ শুরু করে এবং সফল হয়, তার দেখাদেখি অন্যরাও এ পদ্ধতির দিকে ঝুঁকবে। সমন্বিত পদ্ধতির দিকে যাওয়ার জন্য যে পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, দোদুল্যমানতা, স্বচ্ছতা নিয়ে ভয়, সেগুলো কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে। একটি পদ্ধতি এক দিনেই সাফল্যের মুখ দেখবে না। শুরুতে হয়তো কিছু সমস্যা হবে; কিন্তু শুরুটা তো করতে হবে। আমরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি শুরু করেছিলাম। এখন সবাই করছে। আমরা যদি নেতিবাচক মনোভাব মাথায় নিয়ে শুরু না করি, তাহলে কখনো আমরা সমন্বিত কিংবা গুচ্ছ পদ্ধতিতে যেতে পারব না।
আসন্ন ভর্তি পরীক্ষা সামনে রেখে কোনো একটি গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সদিচ্ছা মুখ্য বিষয়। সরকারের পক্ষ থেকেও পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা কাম্য। আমার বিশ্বাস, সরকার সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে এলে এ বছরই গুচ্ছ পদ্ধতির প্রবর্তন করা সম্ভব। শিক্ষার্থীদের কষ্ট ও অভিভাবকদের ভোগান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সমন্বিত কিংবা গুচ্ছ পদ্ধতির প্রবর্তন অতীব জরুরি। কেননা একই দিনে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হওয়ায় শিক্ষার্থীরাও দ্বিধায় থাকে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় সে অংশগ্রহণ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একান্ত ইচ্ছাই পারে সবাইকে ভোগান্তি থেকে রক্ষা করতে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়