বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের বিশাল একটি অংশ সমুদ্র ও সমুদ্র সংশ্লিষ্ট খাত থেকে এসে থাকে। এছাড়া আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কাতার, দুবাই, জার্মানিসহ অনেক দেশেই মেরিন টেকনোলজিস্টদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দেশে সমুদ্র খাতে দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যদিও দেশে ডিগ্রি পর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও পাবনা; ৫টি মেরিন একাডেমি, মাদারীপুরে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রামে মেরিন ফিসারিজ একাডেমি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিসহ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এছাড়া ডিপ্লোমা পর্যায়ে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অধীনে নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, বাগেরহাটে ৬টি; বাংলাদেশ সমুদ্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ নেভাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিসহ প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর জনবল পাস করে বের হলেও চাকরি ক্ষেত্রে গিয়ে তারা উপযুক্ত সেবা দিতে পারছে না। তার বিপরীতে আমাদেরকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করতে হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তির অভাবে আমাদের সমুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ আর্ন্তজাতিক মানের সেবা দিতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের সমুদ্র শিক্ষাব্যবস্থা।
আমাদের দেশে একজন মধ্যম মানের সমুদ্র প্রকৌশলীকে সমুদ্র খাতের সব বিষয় পড়তে হয়, অপরদিকে ভারতসহ অন্যান্য দেশে সমুদ্র শিল্পের যে কোনো একটি উপখাতকে টেকনোলজি হিসাবে চালু করা হয়ে থাকে। ফলে তারা যে বিষয়ে পড়াশুনা করে সেই বিষয়ে তারা অত্যন্ত দক্ষ হয়। অপরদিকে আমরা সব বিষয় সম্পর্কে অবগত হই বিধায় কোনো উপ-খাতেই ভালোভাবে দক্ষ হতে পারি না। তাই চাকরির বাজারে আমরা উপযুক্ত সেবা দিতে পারছি না। সরকারকে মধ্যম মানের সমুদ্র প্রকৌশলীদের চাকরির বাজারের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন উপ-খাতের ভিত্তিতে টেকনোলজি চালু করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মেরিন বিষয়ক সকল টেকনোলজিকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কারিকুলামের সাথে যুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন সকল টেকনোলজির পূর্বে মেরিন শব্দটি বসানো হয় অর্থাৎ সমুদ্র বিষয়ের শিপবিল্ডিং টেকনোলজির ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (মেরিন শিপবিল্ডিং টেকনোলজি) লিখতে হবে।
সমুদ্র বিষয়ের বিভিন্ন উপ-খাতের ওপর ভিত্তি করে প্রস্তাবিত টেকনোলজি সমূহ হলো ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (মেরিন কোস্টাল এরিয়া ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজি, মেরিন শিপবিল্ডিং টেকনোলজি, মেরিন শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ডিজমান্টলিং টেকনোলজি, মেরিন পোর্ট ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজি, মেরিন ইন ল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ ট্রান্সপোর্টেশন টেকনোলজি, মেরিন ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারওয়েজ ট্রান্সপোর্টেশন টেকনোলজি, মেরিন শিপ আর্কিটেক টেকনোলজি, মেরিন ফিসারিজ টেকনোলজি, মেরিন ওসানোগ্রাফি টেকনোলজি, মেরিন ল টেকনোলজি, মেরিন বোট বিল্ডিং অ্যান্ড রেসটোরেশন টেকনোলজি সমূহ সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক সমূহেও চালু করা সম্ভব হবে।
এছাড়া লক্ষ্য করা যায়, সমুদ্র শিক্ষার জন্য সরকার যে সব স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে একমাত্র চট্টগ্রাম ব্যতিরেকে ৯০ ভাগ প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে কোনো সমুদ্র নেই। এটাও এক ধরনের প্রহসনের সমান । সংস্কৃতিতে একটা কথা রয়েছে, ‘যশ্চিন দেশে যদাচার’; অর্থাৎ যেখানে যেটা দরকার সেখানে সেটা করা উচিত। আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এই ১৪টি উপকূলীয় জেলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম এই ৫টি উপকূলীয় বৃহত্তম জেলা বা অঞ্চল, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম এই ৩টি উপকূলীয় বিভাগ রয়েছে। সমুদ্র বিষয়ক যে কোনো প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হলে সমুদ্র থেকে নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে স্থাপন করাই উচিৎ। তাই পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, সাতক্ষীরা এই ১৩টি উপকূলীয় জেলা সদরে নতুন করে বাংলাদেশ সমুদ্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা প্রয়োজন। অবশিষ্ট পটুয়াখালী, খুলনা, নোয়াখালী এই ৩টি উপকূলীয় বৃহত্তম জেলা বা অঞ্চলে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি স্থাপন করা প্রয়োজন এবং উপকূলীয় ৩টি বিভাগে ৩টি মেরিন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে উপকূলীয় বিভাগের যে জেলায় সমুদ্র বন্দর রয়েছে সেইসব জেলার জেলা সদরকে প্রাধান্য দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে মেরিন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাই অবশিষ্ট ২টি উপকূলীয় বিভাগের মধ্যে খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় ও বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলায় যেহেতু সমুদ্র বন্দর রয়েছে তাই বাগেরহাট ও পটুয়াখালী সদরে মেরিন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে।
বর্তমানে সরকারি পলিটেকনিক সমূহে সমুদ্র বিষয়ক বিভিন্ন টেকনোলজি চালু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এক্ষেত্রে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিটি পলিটেকনিকে সমুদ্র বিষয়ক ১টি টেকনোলজি যাতে চালু সম্ভব হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা একান্ত প্রয়োজন। আর সমুদ্র খাতের আধা-দক্ষ ও দক্ষ টেকনিশিয়ান তৈরির জন্য বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে ভোকেশনাল কোর্স চালু করা একান্ত প্রয়োজন। এসব কোর্স বাস্তবায়নের জন্য ১৪টি উপকূলীয় জেলার প্রতিটি উপজেলায় ১টি করে মেরিন ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করা একান্ত প্রয়োজন। সেখানে মেরিন ফিসক্যাপচার, ফিসিং বোট ড্রাইভার, ইনল্যান্ড ক্যাপচার ফিসম্যান, মেরিন ক্যাপচার ফিসম্যান কাম প্রাইমারি প্রসেসর, ফিসিং বোট ডেকান, ফিসিং বোট ম্যানটেইনেন্স ওয়ার্কার, ফিসিং বোট মেশিনিস্ট, ফিসিং গিয়ার টেকনিশিয়ান, শিপবিল্ডিং পাইপ ফিটার, মেরিন ফিটার অ্যান্ড রিগার, লাজার ইনসুলেটর, শিপ পাম্পম্যান, শিপ পুসার, মেরিন ইলেকট্রনিক্স, মেরিন রেফ্রিজারেশন, স্টাকচারাল ফেব্রিকেটর, শিপ ব্রেকিং স্ক্রাপার, শিপ ব্রেকিংসহ আরও অনেক বিষয়ে ভোকেশনাল কোর্স চালু করা যেতে পারে। ফলে দেশে দক্ষ উচ্চ, মধ্যম মানের সমুদ্র প্রকৌশলী এবং আধা দক্ষ ও দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাব পূরণ করতে সক্ষম হবে। ফলে সমুদ্রখাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব দূর হবে।
লেখক: ট্রেড ইন্সট্রাক্টর, পটুয়াখালী