সরকারের সঙ্গে প্রকাশকদের প্রতারণা : বৃত্তির নিশ্চয়তা দিয়ে নোট-গাইড বাজারে - দৈনিকশিক্ষা

সরকারের সঙ্গে প্রকাশকদের প্রতারণা : বৃত্তির নিশ্চয়তা দিয়ে নোট-গাইড বাজারে

এনামুল হক প্রিন্স, মতিউর মর্তুজা ও আসাদুল ইসলাম |

প্রতিশ্রুতি ভুলে পাল্টি খেয়ে মুফতে মুনাফা লুটতে মাঠে নেমেছেন এক শ্রেণির প্রকাশক। কাগজ সংকটের কারণে এ বছর পাঠ্যবই ছাপা শেষ হওয়ার আগে অন্যান্য বই ছাপাবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু প্রায় ১২ বছর পর পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার ঘোষণা হতে না হতেই ভোল পাল্টেছেন মুনাফালোভীরা। 

আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় পরীক্ষাকে সামনে রেখে তারা নিষিদ্ধ নোট আর গাইড বইয়ে বাজার ভরিয়ে ফেলেছেন। এসব বইয়ের মোড়কে লিখে ‘বৃত্তি পাওয়ার নিশ্চিয়তা’ও দেয়া হচ্ছে। এমনকি তাদের প্রতিনিধিরা স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের নানা সুবিধা পাইয়ে দিয়ে নিজেদের নোট ও গাইড বই এর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। 

দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা আয়োজনের ঘোষণা দেয়ার আগেই শিক্ষা প্রশাসনে নিজেদের নিয়োজিত সোর্সের মাধ্যমে মুনাফালোভী প্রকাশকরা বিষয়টি জানতে পারেন। সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। তাই ঘোষণা হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই বাজারে ছড়িয়ে দেন। 

প্রকাশকদের এই ‘নিষিদ্ধ বাণিজ্যে’ তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের’ (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, কাগজ সংকটে এবার পাঠ্যপুস্তক ছাপায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। এই সুযোগে এক শ্রেণির প্রকাশক বাণিজ্য করতে চাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও বলছেন, ‘বৃত্তির নিশ্চয়তা’ কেউ দিতে পারবে না। এই ‘নিশ্চয়তা’ স্পষ্টতই প্রতারণা। 

ছাপাখানা মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার সরকার প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপছে। এসব বই ছাপতে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন কাগজ প্রয়োজন। কিন্তু দেশে ডলার সংকট, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, গ্যাস সংকট এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এমনিতেই দেশে কাগজের সংকট প্রকট। এ পরিস্থিতিতে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সহায়ক বইয়ের নামে বিক্রি হওয়া ‘নিষিদ্ধ নোট-গাইড’ বইয়ের মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে খোলাবাজারে এ ধরনের নিষিদ্ধ বইয়ের বিক্রি ঠেকাতে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারদের চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের কোনো ধরনের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপই কাজে আসেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম গতকাল রোববার বলেন, প্রতিবছর এই সময়ে পুরোদমে পাঠ্যবই ছাপা হয়। এ সময়ে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ‘নোট-গাইড’ বা ‘সহায়ক’ বই ছাপা হলে, বাজারজাতকরণ হলে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ ব্যাহত হয়। তাছাড়া এবার দেশের কাগজের ‘তীব্র’ সংকট রয়েছে।

এজন্য শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শে এনসিটিবির পক্ষ থেকে সম্প্রতি নভেম্বর-ডিসেম্বরে সব ধরনের ‘নোট-গাইড’ বা ‘সহায়ক’ বই মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখতে রাজধানীর বাংলাবাজারে ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির’ অফিসে গিয়ে সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধ করা হয়েছিল।

প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম আরো বলেন, আমি নিজে গিয়ে প্রকাশকদের কাছে অনুরোধ করেছি, নোট-গাইড বা সহায়ক বই ছাপা বন্ধ রাখতে। এখন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খরব পাচ্ছি, বাজারে এ ধরনের বই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এটা সরকারের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান আরও বলেন, একজন অভিভাবক একটি গাইডের ছবি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। আমি ওই গাইডের প্রকাশককে বলেছি। কিন্তু, ছোটন (পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন) তো ফোনই ধরে না।  

প্রতারকদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমাদের আওতায় ব্যবস্থা নেয়ার মতো হলে নেবো। 

এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, যারা সরকারের পাঠ্যবই ছাপার কাজ করছেন তাদের কেউ কেউ নিষিদ্ধ ‘নোট-গাইড’ ছাপছেন। নাম দিচ্ছেন সহায়ক বই। এ কারণে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজও ঢিলেঢালাভাবে এগুচ্ছে। এনসিটিবি কর্মকর্তারা বিভিন্ন জেলা থেকে ‘নোট-গাইড’ বা সহায়ক বই সংগ্রহ করছেন। এরপর বইয়ের প্রকাশকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে তারা জানিয়েছেন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল রোববার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আগামীকাল তাদেরকে ডাকা হয়েছে। আমরা অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব; এটা আমাদের কমিটমেন্ট। 

তিনি জানান, দু’একটি প্রকাশনা এ ধরনের বই বাজারজাতকরণ করেছে। যদিও এনসিটিবির কর্মকর্তারা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছেন অন্তত পাঁচটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ বই খোলাবাজারে বিক্রি করছে। ইতোমধ্যে ‘নিষিদ্ধ বই’ ছাপার অভিযোগে দুটি ছাপাখানার মালিককে এনসিটিবির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে। 

রাজধানীর বাংলাবাজার, নীলক্ষেত, রাজশাহী, যশোর, ঝালকাঠী ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন প্রকাশনীর বিক্রয় কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব নোট ও গাইডেই ‘বৃত্তিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা’ দেয়া হচ্ছে। একটি বইয়ের মোড়কে বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা, প্রশ্নকাঠামো ও মানবণ্টনের আলোকে রচিত’। আর একটি নোট বইয়ের মোড়কে বলা আছে, ‘ট্যালেন্টপুল বৃত্তির নিশ্চয়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা সহায়ক বই’। 

দেখা যায়, লেকচার ও দোলনা প্রকাশনীর বইয়ের দামের নীচেই লেখা রয়েছে ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’ কর্তৃক নির্ধারিত। অথচ এই সমিতিই গত ২৯ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়েছিলেন, কাগজ সংকটের কারণে, পাঠ্যবই ছাপার আগে তারা অন্যসব বই ছাপার কাজ বন্ধ রাখবেন।   

গতকাল রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজশাহী নগরীর মনিচত্বরের লাইব্রেরিগুলোতে নানা রকম গাইড বই সাজানো রয়েছে। দেড়শ থেকে দুশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি গাইড বই।

বিক্রেতারা জানান, তারা এসব গাইড বই ঢাকা থেকে এনেছেন। পদ্মা বই বিতান ও বুক হাউস পাইকারি দরে খুচরা দোকানগুলোতে এসব বই বিক্রি করছেন। এ বিষয়ে পদ্মা বই  বিতানের ম্যানেজার বিদ্যুত হোসেন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, এসব বই বিক্রির বিষয়ে কোন বিধি নিষেধ আছে কিনা আমার জানা নেই।

মনিচত্বরের বই নিকেতন লাইব্রেরির স্বত্ত্বাধিকারি মেহেদি হাসান দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, চাহিদা আছে। তাই বিক্রি করছি। 

বই কিনতে আসা শরিফ নামে এক অভিভাবক দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, বাচ্চাদের স্কুলে ঠিকমত পড়াশোনা করালে গাইড বইয়ের প্রয়োজন হতো না।

রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. সাইদুল ইসলাম দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, স্কুলে গাইড বই পড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। যদি কোনো শিক্ষক স্কুলে গাইড বই নিয়ে যায় বা পড়ায় তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বাজারে বিক্রি হলেও আমাদের কিছু করার নেই। বাজার মনিটরিং করা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) জয়া মারীয়া পেরেরা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন,  অভিভাবকদের চাহিদা থাকায় এসব বই বিক্রি হচ্ছে। আমরা সব সময় গাইড বই কিনতে নিরুৎসাহিত করি। 

কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে - dainik shiksha কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা - dainik shiksha ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন - dainik shiksha সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল - dainik shiksha ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে - dainik shiksha নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0089261531829834