মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের সব পাঠ্যবই ফের পরিমার্জন করা হচ্ছে। তবে পাঠ্যবইয়ের ‘কনটেন্ট’ (পাঠ্যক্রম) পরিবর্তনের উদ্যোগ নেই। ২০১৬ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রমে সাম্প্রদায়িকীকরণ, ভুলভ্রান্তি ও অপ্রাসঙ্গিক উপাদান থাকায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রম পরিবর্তন ও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পাঠ্যবইয়ে আগের ‘কনটেন্ট’ই অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক এবং পশ্চাৎপদ লেখাই বহাল রয়েছে। ‘সমালোচিত পাঠ্যসূচি বা লেখাসমূহ বহাল রেখে ফের পাঠ্যক্রম পরিমার্জনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ের ‘কনটেন্ট’ পরিবর্তনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সায় দিচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
২০১৬ সালে ছাপানো ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের ১১টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ওইসব বই তুলে দেয়া হয় শিক্ষামন্ত্রীর হাতে। এক বছর যেতে না যেতে ফের পাঠ্যবই পরিমার্জনের উদ্যোগে বিরক্ত পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও তা মুদ্রণের দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, পাঠ্যবইকে সাম্প্রদায়িকীকরণমুক্ত করার উদ্যোগ নিই। অপ্রাসঙ্গিক অনেক উপাদান থাকলেও গত বছর সেগুলো পরিবর্তন করতে সম্মতি দেয়নি শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিমার্জনের নামে ছোট ছোট ভুলত্রুটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। আবার পরিমার্জনের পরও একই রকম ভুলত্রুটি কীভাবে বইয়ে থাকে সেটি খতিয়ে দেখা উচিত বলেও এনসিটিবির কর্মকর্তারা মনে করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা সংবাদকে বলেন, ‘প্রতি বছরই পাঠ্যবইয়ে কিছু ভুলত্রুটি টিহ্নিত হয়। এবারও এসব সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে প্রিন্টিং মিসটেক (ছাপার ভুল), তথ্য কালেকশনে মিসটেক (ভুল তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপন), ভাষাগত ত্রুটি, বানান ভুল, ছাপায় অস্পষ্টতা- ইত্যাদি সমস্যা থেকে যায়। এজন্য ৬ষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর সব বই পরিমার্জনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
এনসিটিবিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মোট ৫৭৪টি বিষয়ের পাঠ্যবই ছাপানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের ৩৩টি ও ইংরেজি ভার্সনের ২৩টি, ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের ১০২টি ও ইংরেজি ভার্সনের ৬৫টি, এসএসসির (ভোকেশনাল) ট্রেড বই ৬১টি, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্রেইল বই ১০৯টি, শিক্ষক নির্দেশিকা (টিজি) ৫৬টি, মাদ্রাসার ইবতেদায়ীর ৩৬টি ও দাখিল স্তরের ৭৯টি এবং পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুর জন্য ১০টি বিষয়ের বই ছাপানো হয়েছে।
এবার ৬ষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের ১০২টি বিষয় ও ইংরেজি ভার্সনের ৬৫টি বিষয়ের বইয়ে নানা রকম ভুলত্রুটি, অসঙ্গতি বেশি রয়েছে বলে এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সংবাদকে জানিয়েছেন। এসব বই পরিমার্জনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এনসিটিবি। বই পরিমার্জনের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কাছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের তালিকা চেয়েছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
গত ২৪ জানুয়ারি মাউশি’কে দেয়া এনসিটিবির চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘২০১৯ শিক্ষাবর্ষের জন্য এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিতব্য ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণীর ৬৫টি ইংরেজি ভার্সন পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন করা হবে। বিদ্যমান ইংরেজি ভার্সনের মানোন্নয়ন এবং পরিমার্জনের জন্য সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক অথবা অধ্যাপক পর্যায়ের ৬৫ জন কর্মকর্তার তালিকা প্রয়োজন।’
গত ৩১ জানুয়ারির মধ্যে এই তালিকা চাওয়া হলেও গতকাল নাগাদ তা পায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অধীনন্থ এনসিটিবি। বাংলা ভার্সনের বই পরিমার্জনের জন্যও পৃথক তালিকা চাওয়া হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা।
গত বছর দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরের ১১টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করা হয়। এর মধ্যে নবম-দশম শ্রেণীর গণিত, উচ্চতর গণিত, বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান, বাংলা সাহিত্য, ইংলিশ ফর টুডে, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, বাংলাদেশ ও বিশ্ব সভ্যতা এবং অর্থনীতি বিষয়ের বই।
পরিমার্জনের এক বছরের মাথায় পুনরায় পরিমার্জনের কারণ সম্পর্কে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘পাঠ্যবই পরিমার্জন একটি চলমান কাজ। তাছাড়া গত বছর সংশোধনের পরও এবার নতুন করে ভুলত্রুটি চিহ্নিত হতে পারে, এজন্য পরিমার্জনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের বেশ কয়েকটি বইয়ের পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করে সাম্প্রদায়িকীকরণের অভিযোগ ওঠে; কিন্তু এসব বিষয় পরিবর্তনের উদ্যোগ নিই। গত শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন মহলে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছিল, ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে সানাউল হকের পদ্য ‘সভা’ বাদ দিয়ে জসীম উদদীনের পদ্য ‘আসমানী’ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য ‘বলাই’ বাদ দিয়ে তার গদ্য ‘কাবুলিওয়ালা’ অন্তর্ভুক্ত করায়।
এ ছাড়াও ৭ম শ্রেণী থেকে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর গদ্য ‘লাইব্রেরি’ বাদ দিয়ে হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর গদ্য ‘মরুভাস্কর’, রণেশ দাশগুপ্তের গদ্য ‘মাল্যদান’ বাদ দিয়ে হারুন হাবীবের গদ্য ‘পিতৃপুরুষের গল্প’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্য ‘লাল ঘোড়া’ বাদ দিয়ে লীলা মজুমদারের গদ্য ‘পাখি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদ্য ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ বাদ দিয়ে তার পদ্য ‘নতুন দেশ’, সুকুমার রায়ের পদ্য ‘আনন্দ’ বাদ দিয়ে তার পদ্য ‘শ্রাবণে’, কালীদাস রায়ের পদ্য ‘অপূর্ব প্রতিশোধ’ বাদ দিয়ে সুনির্মল বসুর পদ্য ‘সবার আমি ছাত্র’, জসীম উদদীনের পদ্য ‘বঙ্গবন্ধু’ বাদ দিয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের পদ্য ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’, স্বর্ণকুমারী দেবীর পদ্য ‘উপদেশ’ বাদ দিয়ে সুফিয়া কামালের পদ্য ‘সাম্য’, সুভাস মুখোপাধ্যায়ের ‘মে দিনের কবিতা’ বাদ দিয়ে জসীম উদদীনের পদ্য ‘আমার বাড়ি’, ফয়েজ আহমদের পদ্য ‘স্মৃতিসৌধ’ বাদ দিয়ে সিকান্দার আবু জাফরের পদ্য ‘গরবিনী মা-জননী’ অন্তর্ভুক্ত করারও অভিযোগ ওঠে।
৮ম শ্রেণীতে কাজী নজরুল ইসলামের গদ্য ‘বাঙ্গালির বাংলা’ বাদ দিয়ে তার গদ্য ‘ভাব ও কাজ’, জসীম উদদীনের পদ্য ‘দেশ’ বাদ দিয়ে তার পদ্য ‘রুপাই’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এছাড়া ৯ম ও দশম শ্রেণীতে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের গদ্য ‘নিরীহ বাঙ্গালি’ বাদ দিয়ে তার গদ্য ‘সুবেহ সাদেক’ এবং রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা ‘খতিয়ান’ বাদ দিয়ে তার ‘মিছিল’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের আপত্তির কারণে ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়েও রয়ে গেছে ‘ছাগল’ ও ‘ওড়না’ বিতর্ক। সমালোচনার মুখে শিশুদের বইয়ে ছাগলকে গাছের ওপর থেকে নিচে নামানো হলেও বই থেকে বাদ দেয়া হয়নি ‘ওড়না’। অন্তত ৬টি স্থানে ছাগলের ছবি যুক্ত আছে।
এ ছাড়াও প্রথম শ্রেণী থেকে ‘ও’তে ওড়না চাই সরিয়ে ‘ও’তে ওড়না যুক্ত করা হয়েছে প্রাক-প্রাথমিকের বইয়ে। এটি কোমলমতি প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের ‘আমার বই’ এর বর্ণমালায় যুক্ত করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকের বাংলা বইটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘আমার বই’ নামক শিশু শিক্ষার্থীদের বাংলা বইয়ের বর্ণমালা শেখাতে ৩৬ পৃষ্ঠায় ‘ও-তে ওড়না’ বলা হয়েছে। ছবি হিসেবে একটি মেয়ে শিশুর গায়ে ওড়না দেয়া হয়েছে।
সৌজন্যে: দৈনিক সংবাদ