সেসিপ প্রকল্পে ১৩২ কোটি টাকা লোপাট - Dainikshiksha

সেসিপ প্রকল্পে ১৩২ কোটি টাকা লোপাট

নূর মোহাম্মদ |

মাধ্যমিক শিক্ষা খাত বিনিয়োগ কর্মসূচির (সেসিপ) কেনাকাটা ও ভবন নির্মাণে পুকুর চুরি হয়েছে। দরপত্র না দিয়েই পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেয়া, বছর পার না হতেই স্কুল ভবনে ফাটল, নষ্ট কম্পিউটার সরবরাহ, ইন্টারনেটের বিল মেরে দেয়াসহ নানা খাতে এ প্রকল্পে কয়েক শ’ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এর মধ্যে ১৩২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা নিয়ে অডিট আপত্তি উঠেছে। প্রকল্পের সার্বিক লুটপাটের চিত্র আরো বেশি বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। অডিট আপত্তির মধ্যেই এ প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছর জুন মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এ লুটপাটের চিত্র পাওয়া গেছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নকালে মোট ৬৩টি অডিট আপত্তির মধ্যে মাত্র ২১টি নিষ্পত্তি হয়েছে । অডিট আপত্তির অধিকাংশই শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। যা প্রকল্প শেষে এসেও নিষ্পত্তি হয়নি। বাকি আপত্তি যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ও প্রশিক্ষণে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে নয়ছয় হয়েছে এমন চিত্র তুলে ধরে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এ প্রকল্পের অনিয়ম, আর্থিক অস্বচ্ছতা ছিল প্রতিটি স্তরে। বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই কাজ দেয়া হয়েছে পছন্দের ঠিকাদারকে। কাজ না করেই ঠিকাদার বাগিয়ে নিয়েছে অতিরিক্ত বিল। কাজ যতটুকু হয়েছে তাতেও জোড়াতালি। নষ্ট কম্পিউটার দেয়া হয়েছে জেলাপর্যায়ে মাধ্যমিক স্কুলে। ইন্টারনেট লাইনের বরাদ্দ মেরে দেয়া হয়েছে। গুণগতমানের শিক্ষার কোনো নজরদারি ছিল না। একই অনিয়ম ছিল নির্মাণ কাজেও। বছর না পেরোতেই ফাটল দেখা দেয় স্কুল ভবনে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ প্রকল্পের সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে কেনাকাটা ও প্রশিক্ষণ খাতে। প্রশিক্ষণ খাতে পৌনে এক কোটি টাকা হিসেবে গরমিল পাওয়া গেছে। প্রকল্পের অধীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণ কম্পিউটার ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, জিপ, মাইত্রোবাস, মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন স্টেশনারি কেনাকাটার অর্থ নয়ছয় হয়েছে। প্রশিক্ষণ-কর্মশালায় অর্থ নয়ছয়ে মহড়া ছিল। কোনো ধরনের বিল ভাউচার ছাড়াই প্রশিক্ষণার্থীদের গণহারে সম্মানী দেয়া হয়েছে। সেমিনারে অস্বাভাবিক বিল দেখানো হয়েছে। দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে প্রমোদ ভ্রমণ হয়েছে।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, প্রকল্পের যেসব অডিট আপত্তি উঠেছে তা আমার যোগদানের আগে। তিনি বলেন, প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে প্রতিমাসে একবার মিটিং করছি। এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো উত্থাপন হচ্ছে, সমাধান হচ্ছে এবং প্রতিমাসেই প্রকল্পের অগ্রগতির রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে। প্রকল্পের মনিটরিং বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা বলেন, যেসব অডিট আপত্তি সবগুলো আমার যোগদানের আগে। তাই এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দরপত্রের আগে অনেক শর্ত মানলেও কাজ পাওয়ার পর অনেক শর্ত মানা হয়নি। অভিযোগের ব্যাপারে বলা হয়, ঈচঞট ওয়েবসাইটে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না দিয়েই পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেয়া, আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে দরপত্র অনুমোদন, নির্ধারিত সময়ে কাজ না করার পরও ঠিকাদারকে জরিমানা না করা, দরপত্র মূল্যায়নে বাইরের প্রতিনিধি না রাখা, কাজের অতিরিক্ত বিল পরিশোধ, অর্পিত সম্পত্তির ওপর নির্মিত স্কুল ভবনের জন্য নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিল পরিশোধ, নিরাপত্তা জামানত না নেয়া বা মেয়াদ বৃদ্ধি না করা, ভুলভাবে পরিমাপ বইয়ে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অতিরিক্ত বিল পরিশোধ, প্রশিক্ষণ মালামালের জন্য জেলা পর্যায়ে স্টক ও ইস্যু বই সংরক্ষণ না করা, ল্যাব টেস্ট ছাড়া এমএস রডের বিল পরিশোধ করা, ঠিকাদারের কাছ থেকে ভ্যাট ও আয়কর আদায় না করা, অগ্রিমকে ব্যয় হিসেবে দেখানো, পিপি সংস্থানের অতিরিক্ত ব্যয়ে আসবাবপত্র সংগ্রহ ইত্যাদি।

এ প্রকল্পের আওতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ই-লানির্ং পাইলটিং-এর জন্য ২০টি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণ, ৩৫টি মডেল মাদরাসার অবকাঠামো উন্নয়ন, ২৫০টি বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় ৬৬টি নতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনে এ পুকুর চুরি হয়েছে।

প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ৩৮২টি মোটরসাইকেল, ২টি জিপ ও ১টি মাইক্রোবাস কেনার বিপরীতে ২টি জিপ, ১টি মাইক্রোবাস ও ৩৭২টি মোটরসাইকেল কেনা হয়েছে। ১০টি মোটরসাইকেল প্রয়োজনের বাইরে কেনা হয়েছে। ১ হাজার ৬২৪টি ডেক্সটপ কম্পিউটারসহ মোট ৩৮৮৮টি যন্ত্রপাতি সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কেনা হয় ১ হাজার ৪৩৬টি কম্পিউটারসহ ৩ হাজার ৫৬৩টি যন্ত্রপাতি/সরঞ্জাম। চুক্তির বিধান অনুযায়ী ঠিকাদার বীমা কভারেজ অর্জন করতে পারে নাই। আর্থিক বিবৃতি, ব্যয় বিবৃতি ও বিভিন্ন মাঠ কর্মকর্তাদের রসিদের মধ্যে মোট ১৩ লাখ ৫৪ হাজার ৮০৪ টাকার ক্লোজিং ব্যালেন্সের অসঙ্গতি। অর্পিত সম্পত্তির ওপর বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ২০ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৭ টাকা অনিয়মিত প্রদান করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যয়িত অর্থের কোনো নগদ বই রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। প্রশিক্ষণের ৭১ লাখ ১৪ হাজার ২৯৮ টাকার অসঙ্গতি পাওয়া যায়।

আসবাবপত্র কেনা কাটার জন্য প্রদান করা অর্থ সন্দেহজনক বলে মনে হয়। কম্পিউটার, ইউপিএস ও আইপিএস কেনার ক্ষেত্রে অস্পষ্ট/বিবেচনাহীন কেনা হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী নষ্ট হয়ে যাওয়া আসবাবপত্র সরবরাহকারীর কাছ থেকে বদল করা হয়নি। এসব ১১টি আপত্তির মধ্যে ৮টি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। সংযোগ সড়ক নির্মাণের কারণে প্রকল্পের অহেতুক ২ লাখ ৬২ হাজার ৩৫ টাকা ক্ষতি হয়েছে। বিলম্বে কাজ শেষ করার জন্য মোট ৭৭ লাখ ৩ হাজার ৩৩৯ টাকার সমন্বয়কৃত ক্ষতি হয়েছে যা ঠিকাদার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়নি।

শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য অন্তর্ভুক্ত কাজগুলো ছিল অনুন্নয়ন এলাকায় ৬৬টি স্কুল নির্মাণ, শিক্ষার্থীবহুল ২৫০টি বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, ৩৫টি মডেল মাদরাসায় অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ ইত্যাদি। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে ১৮ হাজার ৫৫০ কোটি ৪১ লাখ টাকার বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৮০৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা শতাংশের হিসাবে ৯৬ শতাংশ। প্রকল্পের পরামর্শক দাতারা ২০১০ সালে ডিসেম্বর মাসে পদত্যাগ করলে পরবর্তীতে আর কোনো পরামর্শক নিয়োগ হয়নি। এতে পরামর্শক সেবার কাজ শ্লথ হয়ে পড়ে। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়/সংস্থা পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্বের জন্যও পরামর্শক কাজের চূড়ান্ত ফলাফল পেতে বিলম্ব হয়। এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত উন্নয়নের সুফল পেতে বিলম্ব হয়। প্রকল্পটিতে প্রশিক্ষণ, সেমিনার এবং ডকুমেন্টেশন কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হলেও কোনো যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয়নি যা প্রকল্পের কার্যক্রম যথাযথ বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করেছে। এমনকি পরামর্শক সেবার জন্য মাঠ ও অফিস পর্যায়ে কোন প্যানেল পরামর্শকও ছিল না।

মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) শিক্ষার সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তা এগিয়ে আসে এবং সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (ঝঊঝওচ)-এর আওতায় এ কার্যক্রমের সূচনা হয়। সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (ঝঊঝউচ)’ সেসিপ (ঝঊঝওচ)-এর-ই একটি ফলো-অন প্রকল্প যা ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়।

সূত্র: মানবজমিন

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.021760940551758