সরকার বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। কারন কোনো শিশুকে বিদ্যালয়ের বাইরে রাখা যাবেনা। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক অর্থাৎ প্রত্যোক শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করতে হবে।তবে দারিদ্রের কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু এখনও বিদ্যালয়ে যায়নি কিংবা গেলেও ঝরে পড়েছে।৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী এ ধরনের শিশুদের রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পের মাধ্যমে ‘আনন্দ স্কুল’ নামে শিখনকেন্দ্রে নিয়ে আসার বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত রস্ক প্রকল্প ৯০টি উপজেলায় শিখনকেন্দ্র স্থাপন করে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসে।২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয় রস্ক প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়।নতুন ১০০ উপজেলাসহ ১৪৮টি উপজেলায় এ কার্যক্রম চলে। বলা যায় রস্ক-২ সাফল্যজনক রস্ক-১ প্রোজেক্টের ওপর নির্মিত যা দ্বিতীয় চান্স নামে পরিচিত এবং ৭ লাখ ৮০ হাজার দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে। বিদ্যালয়ের বাইরে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এখানে ফ্লেক্সবিল স্কুল টাইমিং অনুসরণ করা হয়। রস্ক প্রেজেক্টের সাফল্য বলে দিচেছ, শিশুদের বেসিক এডুকেশন দেয়ার জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহার করা যেতে পারে এবং সেই চাহিদাই দেশব্যাপী তৈরি হয়েছে। ফলে সরকার রস্ক মডেলকে গ্রহন করে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা দেশের অন্যান্য এলাকার শিশুদেরকেও এই মডেলে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার প্রকল্প নিয়েছে। ‘প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-৩’ এর মাধ্যমে। সেভ দ্য চিলড্রেন এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর একত্রে এই বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা বিদ্যালয়গমনোপযোগী শিশুদের নিয়ে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছে। উপআনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়াই রস্ক এবং ওওএসসি প্রজেক্টের একটি বৈশিষ্ট্য। তার মানে হচেছ এখানকার বিদ্যালয়ে সময়সূচি কিছুটা নমনীয়, স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই অনুসারে পাঠদান প্রক্রিয়া চলে। একই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে একই প্রশ্নে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে তাদের একটি রিপোর্টে দেখিয়েছিল, ওই বছর প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৮ দশমিক ৪শতাংশ এবং যেসব শিশুরা কখনোই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি কিংবা যায়নি তাদের হার প্রায় দুই শতাংশ। এই হারের ওপর ভিত্তি করে হিসেব করা হয়েছে যে, সারাদেশে ৮-১৪বছর বয়সী প্রায় ২ দশমিক ৮মিলিয়ন শিশু রয়েছে যারা বিদ্যালয়ের বাইরে অবস্থান করছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির ( পিইডিপি-৪) এর আওতায় আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন এর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে যা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই থেকে ২০২৩-এর জুন পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে বিদ্যালয় বহির্ভূত (৮-১৪বছর বয়সী) ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠনিক শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দান করবে এবং তাদেরকে শিক্ষার মূল ধারায় সংযুক্ত করবে। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১০ লাখ শিশুর মধ্যে এক লাখ শিশু এর আগে শেষ হওয়া পিইডিপি-৩ এর অধীনে ২০১৭-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন পর্যন্ত কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। পিইডিপি-৪এর প্রকল্প দলিল এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উক্ত এক লাখ শিশুর শিখন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ব্যুরো পার্টনার এনজিও-র মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে দেশের ছয়টি জেলায় (ঢাকা, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধা, সিলেট এবং সুনামগঞ্জে) পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে এক লাখ শিক্ষার্থীদের জন্য এই কার্যক্রম চলছে যা শেষ হতে যাচেছ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। তবে, শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক বিদ্যালযে ভর্তির কারণে এটি মার্চ ২০২২ পর্যন্ত চলবে। এই এক লাখ শিক্ষার্থীর জন্য চারটি মডেলভিত্তিক স্থাপিত ৩ হাজার ৩৩২টি শিখনকেন্দ্রে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আশি কোটি টাকা আসবে দাতাদের কাছ থেকে বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। এই কর্মসূচির আওতাধীন চারটি মডেল হচেছ ক. এবিএল মডেল যা ৪৫ মাস ব্যাপী কোর্স। প্রতিদিন ২ঘন্টা ৪০ মিনিট বিরতিসহ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত পাঠদান। খ. মাল্টিগ্রেড মডেল-৪২মাস ব্যাপী কোর্স, প্রতিদিন ২ ঘন্টা বিরতিসহ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দুই শিফটে পাঠদান। গ. কোহর্ট মডেল- ৪৮মাস মেয়াদী কোর্স, প্রতিদিন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য ৩ঘন্টা, তৃতীয় শ্রেণির জন্য ৩ ঘন্টা ৩০ মিনিট, চতুর্থ শ্রেণি ও পঞ্চম শ্রেণির জন্য ৪ ঘন্টা পাঠদান। ঘ. শিখন মডেল- ৪৮মাস মেয়াদী কোর্স। প্রতিটি মডেলে ২৫-৩০জন শিক্ষার্থীকে একটি শ্রেণিকক্ষে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি সম্পন্ন একজন শিক্ষক কর্তৃক এনসিটিবির কারিকুলাম ও টেক্স্ট বই অনুসরন করে পাঠদান করা হয়। বাকী নয়লাখ শিশুর জন্য ৬১টি জেলায় কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা কিন্তু বিভিন্ন কারনে তা দেরি হচ্ছে।তিনটি পার্বত্য এলাকা-রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই কর্মসূচি বাইরে রয়েছে।
আউট অব স্কুল চিলড্রেন ( ওওএসসি) প্রোগ্রাম সরকারের একটি মহতী উদ্যেগ।এই প্রজেক্টের মাধ্যমে যেসব শিশু কখনও বিদ্যালয়ে যায়নি কিংবা কোন না কোন কারণে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে তাদের জন্য শিক্ষার আলো বিতরণ করা হচেছ। এই প্রজেক্টের অন্যতম উদ্দেশ্য প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী শেষে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্থানান্তরকরণ। তবে,কোভিড-১৯ অবস্থার কারণে এইসব শিশুদের শিক্ষার করুণ হাল হয়েছে। যে পরিমাণ লার্ণিং গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে তা নিরুপনের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। কিন্তু ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। যার ফলে এই প্রজেক্টের অন্তভুর্ক্ত শিশুদের আরও অন্তত একবছর নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখা প্রয়োজন এবং এই এক বছরের মধ্যে তাদের কোনো না কোনো বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেয়া যেতে পারে যেটি তাদের জন্য সারা জীবন নিরাপত্তা বয়ে আনবে, উপকৃত হবে তাদের পরিবার, দেশ ও সমাজ । বেকারত্ব ও বেকারত্বের কারণে যেসব অসামাজকি কার্যাবলী সমাজে সংঘটিত হয় সমাজ সেগুলো থেকে মুক্তি পাবে। ফলে, প্রকৃত অর্থেই জনপ্রিয় হবে অত্র প্রজেক্টের কার্যাবলী। পরবর্তীতে যারা এই প্রজেক্টের আওতাভুক্ত হবে তারা আগ্রহভরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করবে কারন তারা জানবে যে, এই প্রজেক্ট তাদের যেনতেন প্রকারে ছেড়ে দেবেনা, তারা মাধ্যমিকে ভর্তি হবে এবং প্রজেক্ট তাদেরকে একটি বাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিবে।
সেকেন্ড চান্স এডুকেশনে ভর্তিকৃত একলাখ শিক্ষার্থীদের যে বিশাল লানিং লস হয়েছে সেটি পোষানোর জন্য এসব শিশুদের কমপক্ষে চার মাসের একটি ব্রিজিং কোর্স ও রেমেডিয়াল কোর্স চালু করা প্রয়োজন। কারণ অবস্থাপন্ন পরিবারের শিশুরা সরকারি বেসরকারি সহায়তায় পড়াশুনার কিছুটা টাচে থাকতে পেরেছে যা এসব শিশুদের ক্ষেত্রে সেভাবে সম্ভব হয়নি কারন তাদের তো বাসায় টিভিও নেই, মা বাবার স্মার্ট ফোনও নেই। তাই, তারা যে লার্ণিং গ্যাপ নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হবে ওই গ্যাপ পূরণ করা তাদের জন্য বেশ কঠিন হবে।আর ষষ্ঠ শ্রেণিতে যদি তারা ভর্তিই না হয় তাহলে সব প্রচেষ্টাই বলা যায় বৃথা যাবে। কারন তারা ভুলে যাবে অর্জিত দক্ষতাগুলো--পড়া, লেখা, বলা, শোনা, হিসেব করার মতো দক্ষতাগুলো চর্চার অভাবে হারিয়ে যাবে যেটি হতে দেয়া উচিত নয়। মাধ্যমিকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসব শিশুদের পুরো ষষ্ঠ শ্রেণির বছর খেয়াল রাখতে হবে, বিদ্যালয়ে যাচেছ কিনা, নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে কিনা, পরীক্ষাগুলোসহ অন্যান্য একাডেমিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহন করছে কিনা, শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাসহ ষষ্ঠ শ্রেণি পার করে দেওয়া পর্যন্ত এই প্রজেক্টের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তাদের হেলথ ও হাইজিন, মেন্টরিং প্রোগ্রামের আওতায় তাদের নিয়ে আসতে হবে।
এদিকে বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা নয়লাখ শিশুv কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে কারণ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে দেশে প্রকৃতঅর্থে এখন আর এত বিশাল সংখ্যক শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে নেই। তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে না পড়লেও দেশের আনাচে কানাচে গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন কিংবা অনিবন্ধিত মাদরাসায় পড়াশুনা করছে। কথাটির যুক্তি আছে তবে, বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার জন্য কিন্তু কারো হাতেই কোনো পরিসংখ্যান ও কৌশল নেই।শহরের বস্তিগুলো ঘুরলেই বুঝা যাবে কত শতাংশ শিক্ষার্থী এখনও বিদ্যালয়ে আসছে না কিংবা আসলেও ঝরে পড়েছে। তারচেয়েও বড় কথা হচেছ, করোনার কারণে তো অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়েছে । তাদের জন্য কি করা হবে? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তৃতীয় কোন সংস্থা দ্বারা জরিপ করিয়ে দেখতে পারে আসলেই কোনো শিশু বিদ্যালয় বহির্ভূত আছে কিনা।আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার মান এখনও পিছিয়ে আছে সত্যি কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার পুরো ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী কারন প্রায় ৬৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় রাষ্ট্র পরিচালিত।উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য যাচাই করা যেতে পারে।আমরা কোনো শিশুকেই বিদ্যালয়ের বাইরে রাখতে চাইনা। কিন্তু প্রকৃত অনুসন্ধানের কারনে যদি কিছু শিশু আসলেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয় সেই ব্যর্থতার দায় কে নেবে? বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।
মাছুম বিল্লাহ: প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( ইট্যাব)