আড়াই বছরেও আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য প্রথম ধাপের নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ। অথচ এরই মধ্যে হাইকোর্টে তালিকাভুক্তির জন্য নতুন করে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগে হাইকোর্টে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিলেই হতো। নতুন করে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার বিধান যুক্ত করায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার আইনজীবী সমিতির সদস্যরা। বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, আইনজীবীদের সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও দেশের আইন পেশার সর্বোচ্চ সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে গত ২৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে পেশা পরিচালনার জন্য এখন থেকে এমসিকিউ (নৈর্ব্যক্তিক) পরীক্ষা দিতে হবে। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে প্রার্থীকে নূ্যনতম ৫০ নম্বর পেতে হবে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সময় এক ঘণ্টা। বিজ্ঞপ্তিতে ফরম পূরণের নির্দেশাবলিও উল্লেখ করা হয়।
জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিও হাইকোর্টে তালিকাভুক্তির জন্য এমসিকিউ পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে তাদের আপত্তি জানিয়েছে। তবে এখনও হাইকোর্টে তালিকাভুক্তির জন্য এমসিকিউ পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়নি বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, 'হাইকোর্টে তালিকাভুক্তির জন্য পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি এনরোলমেন্ট কমিটির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। আগে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল কম। এখন অন্য পেশায় থেকেও অনেকে পরীক্ষা দিয়ে আইন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। সে জন্যই চাপ কমাতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি বহাল আছে। অবশ্য বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেছেন, 'হাইকোর্টে তালিকাভুক্তির জন্য নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন। বার কাউন্সিলের পরবর্তী সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।'
হাইকোর্টের তালিকাভুক্তিতে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার বিধান বাতিল হবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, আইনজীবীদের অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন। যতদূর জেনেছি নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি বাতিল হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি গাজী মো. শাহ আলম বলেন, 'হাইকোর্টে তালিকাভুক্তিতে বার কাউন্সিলের আগের নিয়মই বহাল থাকা উচিত। হঠাৎ করে পরীক্ষার যে আরও একটি ধাপ বাড়ানো হয়েছে, সেটি উচ্চ আদালতে আইন পেশায় যারা যেতে চান তাদের জন্য দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করবে। তা ছাড়া পরীক্ষাও নিয়মিত হয় না। এ বিষয়ে ঢাকা বারের কার্যকরী কমিটিতে প্রাথমিক
আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই সভার সিদ্ধান্ত বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হবে।'
হাইকোর্টে তালিকাভুক্তির জন্য অপেক্ষায় থাকা রাজবাড়ী জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অভিজিৎ সোম বলেন, 'হাইকোর্টে নতুন করে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা গ্রহণের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেটি উচ্চ আদালতে পেশা পরিচালনার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করবে। কারণ পরীক্ষাই যথাসময়ে গ্রহণ করা হয় না। এক্ষেত্রে পরীক্ষার ধাপ অতিক্রম করে হাইকোর্টে তালিকাভুক্ত হতেই দুই-আড়াই বছর লেগে যাবে। এটি তরুণ ও প্রবীণ সব আইনজীবীর জন্যই হতাশাজনক। সবাই তার পেশায় সর্বোচ্চ শিখরে যেতে চায়। দীর্ঘসূত্রতার কারণে সেটি বাধাগ্রস্ত হবে।'
ঢাকা বারের আইনজীবী ইনজামাম-উল ইসলাম খান বলেন, 'তিন ধাপে মেধা যাচাইয়ের পর নিম্ন আদালতে আইনজীবীরা তালিকাভুক্ত হন। এর পরেও তাদের যদি আরও তিন ধাপে পরীক্ষা দিয়ে হাইকোর্টে তালিকাভুক্ত হতে হয়, সেটি উদ্বেগজনক। কারণ এরপর আপিল বিভাগে তালিকাভুক্তির বিষয়টিও রয়েছে।'
এনরোলমেন্ট পরীক্ষা ২৮ ফেব্রুয়ারি :আড়াই বছর অপেক্ষার পর আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি এনরোলমেন্ট পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছেও এক চিঠিতে ওইদিন পরীক্ষা কেন্দ্র বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে পরীক্ষা গ্রহণের সম্মতিপত্র, পরীক্ষার্থীপ্রতি সম্মানী হার এবং ৫৫ থেকে ৬০ হাজার পরীক্ষার্থীর সম্ভাব্য সিট প্ল্যান বার কাউন্সিল সচিবের কাছে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা গ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করছি এবার পরীক্ষা হবে। তিনি জানান, বার কাউন্সিলের ভবন নির্মাণের জন্য কার্যালয় স্থানান্তর এবং জাতীয় নির্বাচনের কারণে পরীক্ষা নেওয়া যায়নি।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২১ জুলাই আইনজীবী প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী বছরে দু'বার এই পরীক্ষা গ্রহণের কথা। বিধি অনুযায়ী, বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই তারা নিম্ন আদালতে সরাসরি মামলা পরিচালনা করার সুযোগ পাবেন। এ জন্য প্রথম ধাপে একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষানবিশ আইনজীবী নূ্যনতম ছয় মাস কাজ করার পর তাকে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে হয়। ওই পরীক্ষায় যারা পাস করেন তারা লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের পরে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর আইনজীবী তালিকাভুক্তির চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করে বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ। সবশেষ নৈর্ব্যক্তিক (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৩৪ হাজার ৩৮৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১১ হাজার ৮৪৬ জন কৃতকার্য হন। পরে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে সাত হাজার ৭৩২ জন উত্তীর্ণ হন। বার কাউন্সিল আগে রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড়ে নিজস্ব কার্যালয়ে থাকলেও গত এপ্রিলে ওই ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে বার কাউন্সিলের কার্যক্রম রাজধানীর বাংলামটর ও পরীবাগে ভাড়া ভবনে পরিচালিত হচ্ছে।