বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা। বরিশালের আবাসিক হোটেল এরিনার সপ্তম তলায় কনফারেন্স কক্ষের একটি টেবিলে চার তরুণ ও দুই তরুণী বসে আছেন, হাতে তাঁদের কাগজ-কলম। তাঁরা পরস্পর পরিচিত এটা বোঝা যাচ্ছিল, কারণ একে অন্যের সঙ্গে খুনসুটি করে সময় পার করছিলেন। পাশেই চেয়ারে বসে আছেন আরও চার ব্যক্তি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় চা-চক্রে বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা চলছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে জানা গেল ভিন্ন কথা। বাকেরগঞ্জ উপজেলার হযরত আলী ডিগ্রি কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা চলছিল সেখানে। যাঁরা খাতা-কলম নিয়ে বসে আছেন তাঁরা ‘পরীক্ষার্থী’ আর তাঁদের পাশে চেয়ার নিয়ে বসা ব্যক্তিরা ‘কক্ষ পরিদর্শক’।
এই প্রতিবেদক ভেতরে ঢুকে একজন কক্ষ পরিদর্শকের কাছে তাঁর নাম জানতে চাইলে তিনি তা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অপর তিনজনও একই আচরণ করেন। পরে জানা যায় ওই চারজনের একজনও কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নন। তাঁরা কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আর এ হাওলাদারের সহযোগী। সভাপতির নির্দেশ, তাই তাঁরা এখানে ‘পরিদর্শকের দায়িত্ব’ পালন করছেন। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজির প্রতিনিধি বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জসীম উদ্দিন ও হযরত আলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ জাকির হোসেন একই হোটেলের ৩০৩ নম্বর কক্ষে বসে আছেন। তাঁরা সেখানে কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এ হাওলাদারের সঙ্গে বিশেষ আলাপচারিতায় মগ্ন রয়েছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে ৩০৩ নম্বর কক্ষে গেলে আর এ হাওলাদার ক্ষিপ্ত হন এই প্রতিবেদকের ওপর। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা আমার বাসভবনে নেবার ক্ষমতাও আমি রাখি। এখানে নিয়মের কোনো বিষয় নেই। আমার কলেজের পরীক্ষা কোথায় নেব সেটা আমার ব্যাপার। এখানে কারো কিছু করার ক্ষমতা নেই।’
এবার কক্ষের বাইরে এসে কলেজ অধ্যক্ষ জাকির হোসেনের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার ভেন্যু ঠিক করবেন কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। তাঁর সুবিধামতো স্থানে পরীক্ষা নেওয়া হবে—এটাই নিয়ম। তাই তিনি হোটেল এরিনায় পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত দিলে আমরা এখানেই পরীক্ষা নিই।’
তিনি আরও বলেন, পূর্বনির্ধারিত সময় অনুসারে সকাল ১০টায় কলেজের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের দুইটি শূন্যপদে এবং ল্যাব সহকারীর একটি শূন্যপদে ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অপর পাঁচটি পদ যথাক্রমে লাইব্রেরিয়ান, আয়া, অফিস সহায়ক, নিরাপত্তাকর্মী ও নৈশপ্রহরী পদের পরীক্ষাও একই স্থানে দুপুরে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু কতজন আবেদন করেছেন কিংবা কতজন প্রার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন সে তথ্য দিতে রাজি হলেন না তিনি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নিয়োগপ্রত্যাশী বলেন, ‘এই পদগুলোতে গত ১৮ জুলাই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে সভাপতির স্বজনরা উত্তীর্ণ না হওয়ায় কোনো কারণ ছাড়াই ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এরপর ফের পুনর্নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। সেখানে আমরা আবেদন করলেও আমাদের পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়নি। হঠাৎ করেই আমরা জানতে পারি বৃহস্পতিবার সকালে বরিশালের একটি হোটেলে ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।’
ডিজির প্রতিনিধি সরকারি বাকেরগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হোটেল এরিনাকে পরীক্ষার ভেন্যু হিসেবে ঠিক করেছেন। আমাদের বাধ্য হয়ে এখানে আসতে হয়েছে। এর বাইরে কিছু করার ছিল না।’
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘সভাপতি চাইলেই যে কোনো স্থানে কলেজের নিয়োগ পরীক্ষা নিতে পারেন না। আর সেখানে সরকারের (ডিজি) প্রতিনিধি সরকারি কলেজ অধ্যক্ষও যেতে পারেন না। তবে বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ কীভাবে ওই হোটেলে গেলেন তা আমার জানা নেই। আর কলেজের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ পরীক্ষা ওই কলেজেই কিংবা আশপাশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হতে পারত। গোপনে একটি আবাসিক হোটেলে পরীক্ষা নেয়ার মানে হচ্ছে আগে থেকে প্রার্থী নির্বাচিত করা আছে তাঁদের।’