১৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে শিক্ষা অধিদপ্তরের ঠিকাদার শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। শিক্ষা ভবনে ত্রাসের নাম টেন্ডার শফিক। তাঁর পুরো নাম মো. শফিকুল ইসলাম। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রায় সব কাজেই তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ তো নেনই, অন্য কেউ কাজ নিলেও তাঁকে কমিশন দিতে হয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি সব সরকারের সময়ই তিনি এককভাবে রাজত্ব করে যাচ্ছেন শিক্ষা ভবনে। শিবির আর ছাত্রদলের হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান হলেও পরে একসময় তিনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেও বর্তমানে তিনি যুবলীগের নেতা। আর এই পরিচয়েই এখনো পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন টেন্ডারবাজি।
এর আগে গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) পাঠানো চিঠিতে টেন্ডারবাজ মো. শফিকুল ইসলামের ব্যাংক হিসাব তলব করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সাথে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীসহ রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, কাস্টমস কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ ১০৫ জনের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে।
জানা যায়, শফিকুল ইসলাম নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ঢাকা আলিয়া মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। সেখানেই শিবিরের হাত ধরে তাঁর রাজনীতিতে পদার্পণ। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে ভর্তি হয়ে চলাফেরা করতেন ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগে যোগ দেন শফিক। একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল ছাত্রলীগের সভাপতি হন। এর পর থেকেই মূলত তাঁর ‘টেন্ডারবাজি’ শুরু।
অপর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিভিন্ন গণমাধ্যমের কার্ডধারী শিবিরের নেতা-কর্মীদের অর্থ সহায়তা করেন। যা শিক্ষাভবনে ওপেন সিক্রেট।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, মূলত ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর ও শিক্ষা ভবনে থাকা প্রায় ১৪টি প্রকল্পের ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় জড়িয়ে পড়েন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইসিটি বিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শফিক। ছাত্রদলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক ও সন্ত্রাসী নাসির উদ্দিন পিন্টুর বাহিনীরা সাথে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে জড়ান শফিক।
শফিকের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম শফিক এন্টারপ্রাইজ। এ ছাড়া আরও একাধিক নামে তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে। বর্তমানে শুধু রাজধানীতেই তাঁর প্রায় ২০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ চলমান। প্রভাব খাটিয়ে ঠিকাদারি আর কমিশন বাণিজ্য করে তিনি এখন প্রায় হাজার কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় রয়েছে পাঁচ-সাতটি বাড়ি ও ফ্ল্যাট। ঢাকার দক্ষিণখানের ২৩৪ হলান রোডে দুই বিঘার ওপর জমিতে বিশাল বাংলো বাড়িতে তিনি থাকেন। এ ছাড়া হাতিরপুর, গুলশান, উত্তরায় আছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজায় তাঁর ৩০টির মতো দোকান আছে। তাঁর অফিসের ঠিকানা ৬৯ বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড (৫ম তলা), হাতিরপুল, ঢাকা।
জানা যায়, ঠিকাদারি তাঁর মূল পেশা নয়। তাঁর মূল পেশা টেন্ডারবাজি। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট যে কোনো কাজ যেই পাক না কেন প্রতিটি টেন্ডারে ৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয় শফিককে। এর মাধ্যমেই মূলত তিনি বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। তিনি শিক্ষা ভবনে গেলে সঙ্গে থাকে একাধিক গাড়ি। নিজে একটি গাড়িতে থাকেন। আর শিক্ষা ভবনের দুই গেটে থাকে আরও দুটি গাড়ি। সঙ্গে থাকে দলবল।
সূত্র মতে, শিক্ষা ভবনে মিজান গ্রুপ নামে আরেকটি গ্রুপ আছে। ওই গ্রুপের নেতা মিজানুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ রহমান হল ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তবে তিনি শফিক গ্রুপের সঙ্গে পেরে না উঠে কখনো তাঁর সঙ্গে হাত মেলান আবার মাঝেমধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। বর্তমানে দুজনের সম্পর্ক ভালো নয়। গত বছরও শিক্ষা ভবনে এই দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তেরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘শফিকের বর্তমানে যে পরিমাণ সম্পদ আছে এর বৈধ হিসাব তিনি কখনোই দিতে পারবেন না। কারণ তিনি তো ঠিকাদারির চেয়ে টেন্ডারবাজি বেশি করেছেন। জোর করে কমিশন আদায়ই তাঁর মূল পেশা।।
বর্তমানে ঢাকায় শফিকের যেসব কাজ চলছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা কলেজের ১০ তলা ভবন নির্মাণ, ধানমণ্ডি মহিলা কলেজের ছয়তলা ভবন নির্মাণ, নায়েমের একটি ভবনের সপ্তম থেকে দশম তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ, মিরপুর বাঙলা কলেজের একাডেমিক ভবন ও মাল্টিপারপাস হল নির্মাণ, সরকারি তিতুমীর কলেজের একাডেমিক ভবন ও ছাত্রাবাস নির্মাণ, ধামরাই টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবন নির্মাণ।
জানা যায়, ঢাকা কলেজে ১০ তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন নির্মাণের কাজ চারতলা পর্যন্ত করে ফেলে রেখেছে শফিক এন্টারপ্রাইজ। সেখানে একাধিকবার নিম্নমানের কাজেরও অভিযোগ উঠেছে। ধানমণ্ডি মহিলা কলেজে নিম্নমানের রড ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। তিন নম্বর রড দিয়ে এই ভবনের কাজ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রকৌশলীদের আপত্তিতে দুইবার রড পরিবর্তনে বাধ্য হয় শফিক এন্টারপ্রাইজ। এ ছাড়া শফিকের একাধিক কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করতে না দেয়ায় তিনি নিজেই কাজ বন্ধ করে রেখেছেন। তবে এখন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের নিয়মিতই হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। নিম্নমানের কাজ ধরতে গিয়ে প্রকৌশলীরাই এখন আতঙ্কে আছেন।
সূত্র মতে, কয়েক বছর আগেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে ইজিপি চালুসহ ইইডির আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা মাঠপর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। ফলে নিজ নিজ অঞ্চলে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু তা মেনে নিতে পারেনি শফিক গ্রুপ। তারা চায় ম্যানুয়ালি দরপত্র আহ্বান, যাতে তারা ইচ্ছামতো কাজ বাগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ইইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী তাতে কোনোভাবেই রাজি হননি। ফলে তাঁর বিরুদ্ধেও অপপ্রচার, হুমকি-ধমকি ও মামলা দিয়েছেন শফিক। ঠিকাদারদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় গত ৫ জুলাই ইইডি প্রকৌশলী-কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ শিক্ষা ভবনে একটি সভাও করে। সেখানে প্রকৌশলীরা জানান, ইজিপি ছাড়া কোনোভাবেই সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দ যথাসময়ে ব্যয় করা সম্ভব নয়।
জানা যায়, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ইইডিতে টেন্ডার দখলে গিয়ে গোলাগুলিতে লিপ্ত হয়েছিলেন শফিক। তখন মাউশি অধিদপ্তর ও ইইডির চার কর্মকর্তা-কর্মচারী গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এরপর শফিককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তখন তাঁর নামে টেন্ডারবাজির মামলাও হয়েছিল। এর কিছুদিন পর শফিককে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে শফিক তাদের সঙ্গে মিশে দোর্দণ্ড প্রতাপে আবার টেন্ডারবাজি শুরু করেন। শিক্ষা ভবন, খাদ্য ভবন ও বিদ্যুৎ ভবনে টেন্ডারবাজি চালিয়ে যান। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে মিশে যান শফিক। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা ভবনের টেন্ডার নিয়ে মুহসীন হল ছাত্রলীগের মাহী গ্রুপের সঙ্গে তাঁর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরে তাঁর নামে মামলাও হয়েছিল।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে দিকে শফিক আনুষ্ঠানিকভাবে যুবলীগে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি যুবলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। সর্বশেষ ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমানের ভাতিজার সঙ্গে টেন্ডার নিয়ে বড় সংঘর্ষে জড়ান শফিক। তাঁর সঙ্গে তখন যোগ দেয় আরেক টেন্ডারবাজ মিজান গ্রুপ।