১৫০ টাকার অ্যানাটমিক্যাল চার্ট যখন ৭ হাজার ৮০০ টাকা - দৈনিকশিক্ষা

হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ১৫০ টাকার অ্যানাটমিক্যাল চার্ট যখন ৭ হাজার ৮০০ টাকা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে ৪৫০টি অ্যানাটমিক্যাল চার্ট সরবরাহ করেছে। প্রতিটির দাম পড়েছে ৭ হাজার ৮০০ টাকা। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মিন্টু দেশোয়ারা। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, অ্যানাটমিক্যাল চার্ট অনলাইন কেনাকাটার ওয়েবসাইট দারাজ ডটকম বিডি থেকে ৪৯৬ টাকায় কেনা যায়। আন্তর্জাতিক অনলাইন কেনাকাটার ওয়েবসাইট আমাজনে মান ভেদে এর দাম দেখানো হয়েছে ৮ থেকে ২৫ দশমিক ৯৫ ডলার। যা বাংলাদেশি অর্থ মূল্যে ৬৭২ থেকে ২ হাজার ১৭৯ টাকা।

হবিগঞ্জ শহরের মিজান মিয়া অ্যানাটমিক্যাল চার্ট বিক্রি করেন। তিনি এই সংবাদদাতাকে জানান, প্রতিটি চার্ট ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় পাওয়া যায়।

এখানেই শেষ নয়। শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে দুটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের জমা দেওয়া কম্পিউটার, প্রিন্টার, প্রজেক্টর, ওজন মাপার যন্ত্র, আসবাবপত্র, বই এবং অ্যানাটমিক্যাল চার্টের যে বিল দেওয়া হয়েছে, তাতে দাম দেখানো আছে বাজারের নিয়মিত দামের থেকে অস্বাভাবিক বেশি।

নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের একটি বিলে হিটাচি স্টারবোর্ডের ৭৯ ইঞ্চি ইন্টারেক্টিভ হোয়াইট বোর্ড সেটের দাম দেখানো হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। 

হিটাচি স্টারবোর্ড ইউএস ডটকম-এ ১৯৫ ডলারে এটি পাওয়া যায় বলে দেখানো আছে। সহজ কথায় ইন্টারেক্টিভ বোর্ডটি এক লাখ বিয়াল্লিশ হাজার টাকায় কেনা যায়।

হবিগঞ্জ শহরে অথেনটিক কম্পিউটারের মালিক নোমান খান জানান, তিনি হিটাচি কোম্পানির ৭৯ ইঞ্চি ইন্টারেক্টিভ বোর্ড এক লাখ ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

একইভাবে পরীক্ষাগার ব্যবহারের জন্য একটি ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্রের দাম পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল তাদের বিলে ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা উল্লেখ করেছে। যেখানে আমাজনে ল্যাবে ব্যবহারের জন্য ভালোমানের ওজন মাপার যন্ত্রের দাম ৭০০ ডলার বা ৫৯ হাজার ৫০০ টাকার বেশি না।

বিলগুলোতে অষ্টম প্রজন্মের কোর আই৫ প্রসেসর সমৃদ্ধ ১১০ মডেলের লেনোভো কোম্পানির ৬৭টি ল্যাপটপের দাম দেখানো হয়েছে ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। সে হিসাবে, প্রতিটি ল্যাপটপের দাম পরে এক লাখ ৪৮ হাজার টাকা। কিন্তু কলেজ কিনেছে ষষ্ঠ প্রজন্মের প্রসেসর সমৃদ্ধ ল্যাপটপ।

এছাড়াও, একটি এইচপি রঙিন প্রিন্টারের (মডেল জেট প্রো এম৪৫২ এন ডব্লিউ) দাম ধরা হয়েছে দুই লাখ ৪৮ হাজার টাকা।

নোমান খান জানান, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ যে মডেলের ল্যাপটপ কিনেছে সেগুলো ৩৯ থেকে ৪২ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায় এবং একই মডেলের এইচপি প্রিন্টারের দাম ২৯ থেকে ৪৫ হাজার টাকা।

১০ জানুয়ারি ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয়েছিল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের। এখন সেখানে ১৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. মো আবু সুফিয়ান ছয় সদস্য বিশিষ্ট দরপত্র কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ফার্নিচার, বই, জার্নাল, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার জন্য দুটি জাতীয় এবং একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় দরপত্র জমা দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেন।

দরপত্র কমিটিতে হবিগঞ্জের তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. সুচিন্তা চৌধুরী এবং জেলার জনসংখ্যা পরিকল্পনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক ড. নাসিমা খানম ইভাও ছিলেন।

সিভিল সার্জনের মতে, দরপত্র সংক্রান্ত কোনো সভার জন্য তাকে ডাকা হয়নি।

সাতটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয় এবং ঢাকার শ্যামলীর নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ এবং মতিঝিলের পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল পণ্য সরবরাহের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলো বলে কলেজ সূত্র থেকে জানা যায়।

ডা. সুচিন্তা চৌধুরী বলেছিলেন যে, স্বাক্ষর করার জন্য তার কাছে এই সভার রেজুলেশনটি পাঠানো হলে, তিনি এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে অধ্যক্ষের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।

কমিটির বাকি সদস্যরা এতে স্বাক্ষর করেন। সে অনুযায়ী নির্ঝড়া এন্টারপ্রাইজ এবং পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

তবে, ডা. নাসিমা দাবি করেন যে, তিনি কমিটিতে ছিলেন না। রেজুলেশনে তার স্বাক্ষর সম্পর্কে জানতে চাইলে, তিনি স্বাক্ষর করার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তার মতে এটি ছিল একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তিনি কোনো মিটিংয়ে অংশ নেননি।

তিনি বলেন, “যদি কোনো দুর্নীতি হয়ে থাকে, তাহলে তার দায় আমি নেবো না।”

বাজারের দামের সঙ্গে সরবরাহকারীদের দেওয়া দাম যাচাই করার জন্য গঠিত আরেকটি কমিটির আহ্বায়ক ডা. শাহীন ভূঁইয়া বলেছিলেন, “যেহেতু অর্থবছরের শেষ মাস জুনে এই দরপত্র ডাকা হয়েছিলো, তাই আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিলো না সবকিছুর দাম যাচাই করার।”

অবশ্য তিনি কোন জিনিসের দাম যাচাই করেছেন, তা বলেননি।

ডা. আবু সুফিয়ান এই সংবাদদাতার ফোন ধরেননি। তবে, ২৬ নভেম্বর জারি করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি দাবি করেছিলেন, পুরো ক্রয় প্রক্রিয়াটি হয়েছে স্বচ্ছভাবে। সেখানে বলা হয়, “গত বছর কোনো আপত্তি ছাড়াই একটি নিরীক্ষা হয়েছিলো।”

শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের জন্য কেনাকাটা করতে গত বছর প্রায় ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিলো। এর মধ্যে ভ্যাট ও আয়করের জন্য এক কোটি ৬১ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয় এবং বাকি ১৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা কেনাকাটায় ব্যয় করা হয়েছে।

এই দরপত্রের সঙ্গে জড়িত একটি সূত্র জানিয়েছে, বাস্তবে সরবরাহকৃত পণ্যের দাম পাঁচ কোটি টাকার বেশি না। হবিগঞ্জের প্রবীণ সাংবাদিক শোয়েব চৌধুরী গত ১৫ অক্টোবর তথ্য অধিকার আইনে নথিগুলির জন্য আবেদন করেন। পরে বিষয়টি নিয়ে প্রথমে স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেছেন, “বিষয়টি আমি বিভিন্ন উৎস থেকে জানতে পেরেছি। তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” অনেক চেষ্টা করেও নির্ঝড়া এন্টারপ্রাইজ এবং পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

গতকাল (৩ ডিসেম্বর) হবিগঞ্জের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) শাখা শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের সরঞ্জাম ও উপকরণ ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়মের প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে।

হবিগঞ্জে দুদকের উপ-পরিচালক কামরুজ্জামান বলেছেন, “গতকাল সকালে আমরা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করি এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এরপর এ বিষয়ে অভিযোগ জানাতে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করবো। প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদনের পরই চূড়ান্ত তদন্ত শুরু হবে।”

এছাড়াও, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মেডিকেল শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগও এই দুর্নীতি তদন্তের জন্য এক সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে।

হবিগঞ্জ সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের সমন্বয়কারী তোফাজ্জল সোহেলের দাবি, এই দুর্নীতির সঙ্গে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. মো আবু সুফিয়ান সরাসরি জড়িত রয়েছেন। এছাড়াও তিনি খোয়াই নদী তীরবর্তী জমি দখল করেছেন।

তোফাজ্জল বলেন, “এটি পুকুর চুরি নয়, নদী চুরি। এই ধরনের মানুষ স্বপদে বহাল থাকলে, সাদা বোর্ডও কালো হয়ে যাবে।”

এ ঘটনায় তিনি জুডিশিয়ারি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040640830993652