‘নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ’ কি হারিয়ে যাচ্ছে? - দৈনিকশিক্ষা

‘নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ’ কি হারিয়ে যাচ্ছে?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আধুনিক যুগের অন্যতম সমাদৃত ইংরেজি সাহিত্যিক টিএস ইলিয়টের ‘ট্রেডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়্যল ট্যালেন্ট’ নামের বিশ্লেষণধর্মী একটি রচনা আছে। সেখানে তিনি কীভাবে একটি সাহিত্যকর্মকে মূল্যায়ন বা গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে সে ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে, কোনো একটি সাহিত্যকর্মকে পর্যালোচনা করতে হলে দুটি বিষয় বর্জন করতে হবে প্রথমটি, সেই লেখকের সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত মতামত এবং দ্বিতীয়টি, সেই লেখকের পূর্বের সাহিত্যকর্মের আলোকে গড়ে ওঠা কোনো বিশ্বাস বা ধারণা। এই লেখাটি সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করার উদ্দেশ্যে লেখা হলেও নিয়মগুলো একজন সাধারণ ব্যক্তি বা কোন ঘটনাকে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সত্যটা হচ্ছে আমি যদি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ঘটনাকে মূল্যায়ন করতে চাই তাহলে আমাকে অবশ্যই ওই ব্যক্তি/ ঘটনা সম্পর্কে আমার পূর্বের ধ্যান-ধারণা বা আমার নিজস্ব মতাদর্শ বিবেচনায় নেয়া যাবে না, বরং ওই ব্যক্তি/ঘটনাকে একটি ব্যক্তিনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করতে হবে। আমরা এমনটা করতে ব্যর্থ হই বলেই অনেক সময় বিভিন্ন তর্কের জন্ম হয়। যেমন বেশ কিছু দিন আগে প্রকাশিত ‘শাড়ি’ লেখাটির জন্য আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদকে নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে। সমালোচনার ক্ষেত্রেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা ছিল। কারণ কে লেখাটি লিখেছে এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কি লেখা হয়েছে। আর সে জন্যই প্রথমে ওই লেখার বিষয়বস্তু ও সেটার উপস্থাপনের ভাষা নিয়ে সমালোচনা হওয়া উচিত ছিল। মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো ঘটেছে। সবাই লেখকের সমালোচনার মুখর হয়ে উঠেছে এবং এর মাধ্যমে আমরা লেখার বিষয়বস্তুর চেয়ে লেখককে বেশি মুখ্য করে ফেলেছি। এমন সমালোচনার থেকে এটা স্পষ্ট যে আমরা লেখাটাকে এবং ওই লেখককেও একটি ‘নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ’ থেকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা প্রায় সবাই এখন একই দোষে দুষ্ট। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থাকাটা কি জরুরি? সমাজ ও ব্যক্তি মননের উন্নতি সাধনে এমন দৃষ্টিকোণের অধিকারী হওয়া খুব প্রয়োজন। নইলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

প্রথমত, একজন ব্যক্তি মানুষের বিচার বুদ্ধি ব্যাহত হবে। উদাহরণস্বরূপ- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মধ্যকার তুলনার ব্যাপারটি বিবেচনা করা যাক। আমাদের দেশের কিছু মানুষ জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর ওপরে জায়গা দিয়ে থাকে (বিশেষত যারা বিএনপির রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী)। এখন নিজেকে একবার প্রশ্ন করে দেখুন তো এই দেশের প্রতি অবদানের কথা বিবেচনায় নিলে কোনোভাবেই কি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিয়াউর রহমানের তুলনা হয়? যে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে অল্প কিছু জ্ঞানও রাখে তার কাছে এটা অজানা থাকার কথা না যে, একজন মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু এই দেশের জন্য কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

দ্বিতীয়ত, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্য বাড়বে। ছোট বেলায় মিনার কার্টুনের একটি পর্ব খুব জনপ্রিয় ছিল। সেখানে দেখানো হয়, মিনা ও রাজুকে খাবার দেয়ার সময় বৈষম্য করা হচ্ছে। রাজুকে মিনার চেয়ে বেশি পুষ্টিকর খাবার দেয়া হয় কারণ রাজু একজন ছেলে। সমাজে এমন বৈষম্য এখনও বিদ্যমান এবং অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের বিভিন্নভাবে পেছনে রাখার চেষ্টা করা হয়। আমরা অনেকেই নারী-পুরুষ সমতার বিষয়টিকে একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে পারি না বলেই সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে বৈষম্য এখনও বিদ্যমান।

তৃতীয়ত, নিরপেক্ষতা না থাকলে সমাজে অস্থিরতা বাড়বে। কারণ- যখন একজন মানুষের মধ্যে চিন্তার নিরপেক্ষতা থাকবে না তখন সে স্বভাবতই কম সহনশীল হয়ে উঠবে। আর সহনশীলতা কমে গেলে ওই ব্যক্তির মধ্যে অস্থিরতা বাড়বে; ফলে যে কোনো ধরনের সহিংস কাজ ঘটাতে পারে। কয়েক বছর আগে আমাদের দেশে বেশ কয়েকজন ব্লগারকে এবং এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে হত্যা করা হয়। যারা এসব ব্লগারকে হত্যা করেছে তারা কিন্তু ব্লগারদের লেখাগুলোকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে কট্টরপন্থিরা খুব সহজেই ওই হত্যাকারীদের উস্কানি দিতে পেরেছে এবং আমরা দেখেছি ব্লগারদের হত্যাকাণ্ড সেই সময় সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল।

পরিশেষে বলা যায় যে, আমরা যদি পক্ষপাতের এই শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে না পারি তা হলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও সুশাসনের সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। পরবর্তী সময়ে সমাজে বিভেদ বেড়ে যাবে এবং একই সঙ্গে সহিংসতা বাড়তে থাকবে। এমতাবস্থায় আমাদের বিবেককে শিক্ষিত করার ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অবশ্যই আমাদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে, কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে মূল্যায়ন করতে হলে সেই দৃষ্টিকোণকে সাময়িকভাবে ভুলে যেতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ দিতে হবে।

মোরশেদুল আলম মহব্বত : সাংবাদিক।

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036458969116211