বিভিন্ন কারণে প্রায় সারাবছর ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করতে হয় স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা বাবামায়ের বদলিযোগ্য চাকুরির কারণে এবং আরো ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ইচ্ছায় বার বার বদল করে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই বদল যে কেবল শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই হয় তা নয়। বছরের প্রথমার্ধে, মাঝামাঝিতে, শেষার্ধে তথা যেকোন সময় হতে পারে।
এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে অধ্যয়নরত থাকাবস্থায় কোন শিক্ষার্থী যদি বছরের মাঝামাঝি অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে একই শ্রেণিতে ভর্তি হতে চায় তো তার বর্তমান প্রতিষ্ঠান থেকে টিসি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে।
কেননা সে এই শেণিতে বর্তমানে পড়ছে এর প্রমান হচ্ছে টিসি। সেক্ষাত্রে বর্তমান প্রতিষ্ঠানে যে মাস পর্যন্ত বেতন-ফি পরিশোধ করে যায় তার পরের মাস থেকে নতুন প্রতিষ্ঠান বেতন-ফি চার্জ করা যুক্তিযুক্ত হলেও বাস্তবে তা হচ্ছেনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। শিক্ষার্থীদের অতি তাগিদে যেহেতু নতুন প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে সেহেতু তাদের জিম্মি করে বছরের শুরু থেকে হিসাব করে সকল ফি আদায় করছে তার নতুন প্রতিষ্ঠান।
তদুপরি এমনও হয় যে তার ছেড়ে আসা প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের শেষদিন পর্যন্ত বেতন-ফি আদায় না করে টিসি দিতে চায়না। ফলে একজন শিক্ষার্থী বদলির কারণে তার অভিভাবককে অনেক সময়ই গুণতে হচ্ছে দিগুণ/তিনগুণ টাকা।
শিক্ষাবোর্ডে রেজিস্ট্রেশন করার পর কোন শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠান বদল করার প্রয়োজন হলে আগে যে হারে ঘাটে ঘাটে ভোগান্তি ও বৈধ অবৈধ পথে অর্থ ব্যয় হতো এখন অনলাইন ব্যবস্থা চালু হবার ফলে তা কিছুটা কমেছে। তবে এইরূপ আবেদনকারী শিক্ষার্থীর নিকট থেকেও কোন কোন ক্ষেত্রে পূর্বাপর উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই যুক্তিযুক্ত প্রাপ্যের অধিক টাকা আদায় করে থাকে।
বোর্ডের ইস্যুকৃত টিসির আদেশে এই সংক্রান্ত নির্দেশণা থাকা প্রয়োজন যে কোন প্রতিষ্ঠান কোন মাস পর্যন্ত বেতন-ফি নিতে পারবে। আরো বেশি গতিশীল হওয়া প্রয়োজন এই অনলাইন ব্যবস্থাটি।
শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় জানুয়ারি মাসে। নতুন বছরের শুরুতে বিভিন্ন কারণে অনেক বেশি শিক্ষার্থী বদল করে থাকে প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি টিসি পেপার সংগ্রহ করার জন্য পূর্ণবছরের সেসন ও অন্যান্য চার্জ এবং জানুয়ারি মাসের বেতন দিয়ে তাদেরকে ভর্তি হতে হয় আগের প্রতিষ্ঠানে। তদুপরি টিসি ফি দিয়ে টিসি পেপারটি নিয়ে গিয়ে অনুরূপ বেতন-ফি পরিশোধ করে পুনরায় ভর্তি হতে হয় কাংখিত নতুন প্রতিষ্ঠানে।
এসংক্রান্ত দু’একটা বাস্তব উদাহরণ দিই, যা এই চলতি জানুয়ারি মাসেই আমি প্রত্যক্ষ করেছি এবং এই লেখাটির তাগিদ অনুভব করেছি। নাম প্রকাশ পেলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী আরো বেশি হয়রানির শিকার হতে পারে এমন ধারনা হচ্ছে বিধায় তাদের ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম গোপন রাখছি।
উদাহরণ-১।
ঢাকা শহরের নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অত্যন্ত ভালভাবে পাশ করেছে। ২০১৬ সেসনে সে খুলনায় অবস্থিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হবে বিধায় ঢাকায় ভর্তি হয়নি এবং হবেনা। কিন্তু খুলনায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠান টিসি চাওয়ার কারণে বেকায়দায় পড়েছে সে। খুলনায় টিসি ছাড়া ভর্তি করবেনা, আর ঢাকায় ভর্তি না হলে টিসি দিবেনা!
ঢাকার প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের এখানে ভর্তিই যদি না হয় তো আমরা টিসি দিব কীভাবে? অর্থাৎ তাদের নির্ধারিত এডমিশন ফিসহ আর্ট-ক্রাফট, বিএনসিসি, বেজ, বুকলিস্ট, কেলেন্ডার, ক্লাস টেস্ট, কম্পিউটার, ডেভেলপমেন্ট, ডায়রি, গালর্সগাইড, আইডি কার্ড, লাইব্রেরি, মেডিকেল, প্রগ্রেস রিপোর্ট, পোস্টেজ, রিসিপ্ট বুক, রিপেয়ার, মেইনটেনেন্স, সাইন্স,স্কাউট, সোল্ডার স্টেপ, স্পোর্টস, সিলেবাস, টিউশন, ওয়েল ফেয়ার ইত্যাদি ফি বাবদ প্রায় দশ হাজার টাকা দিয়ে ভার্তি হয়ে তাদের শিক্ষার্থী হবার পরে তারা টিসি দিবে।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, এই শিক্ষার্থী তো এখানে ক্লাস করবেনা, পড়বেনা তাহলে তাকে এতসব মাসিক ও বার্ষিক ফি দিতে হবে কেন? বড়জোর আডমিশন ফি’র ৫০০/৭০০ টাকা নিতে পারেন।
উত্তর, এত কথা বলে লাভ নেই, এটিই এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম!
অপরদিকে খুলনার সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের এখানে ভর্তি করতে হলে টিসি লাগবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেতো এখন কোথাও ভর্তি নেই, তো তাকে টিসি দিবে কে? কিংবা তাকে ভর্তি করতে টিসি লাগবে কেন? টিসি আনার জন্য সেখানে ভর্তি করে এত টাকা খরচ করবো কেন? সে /তার অভিভাবক যদি লিখে দেয় যে, সে অন্য কোথাও ভর্তি নেই তাহলে কি চলবেনা? কিংবা তার আগের প্রতিষ্ঠান যদি লিখে দেয় যে, অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যাপারে তাদের আপত্তি নেই তাহলে কি তাকে ভর্তি করা যায়না? উত্তর, এত কথা বলে লাভ নেই, টিসি ছাড়া ভর্তি করা হয়না, এটাই এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম!
উদাহরণ-২।
ঢাকাশহরের মোহাম্মদপুরে অবস্থিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জেএসসি পাশ করেছে একজন শিক্ষার্থী। সে ২০১৬ সেসনে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ফার্মগেট এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানে সিলেক্ট হয়েছে। কিন্তু তারা টিসি ব্যতীত তাকে ভর্তি করবেনা। এদিকে যে প্রতিষ্ঠান থেকে সে জেএসসি পাশ করেছে সেই প্রতিষ্ঠানেও ভর্তি না হলে তারা টিসি দিবেনা। এখানে পড়ুক বা না পড়ুক টিসি নিতে হলে নির্ধারিত সকল ফি দিয়ে একমিনিটের জন্য হলেও ভর্তি হতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, জেএসসি / পিইসি / এসএসসি পরীক্ষা পাশের সরকারি সনদ থাকার পরেও তাকে ভর্তি করার জন্য টিসি ও প্রশংসাপত্র লাগবে কেন? যে সনদ এখন অনলাইনে দেখাযায়, পাওয়াযায়, প্রিন্ট করা যায় সেই সনদের কপি সত্যায়িত করা লাগবে কেন আগের প্রতিষ্ঠান প্রধানের? কেন বাড়তি টাকা দিয়ে আগের প্রতিষ্ঠান থেকে আনতে হবে প্রশংসাপত্র? সে খারাপ হলে তো তাকে পরীক্ষা দেওয়ার পূর্বেই বহিষ্কার করে দিত আগের প্রতিষ্ঠান। কিংবা দিতনা তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কোন পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ। সরকারি সনদই যথেষ্ট নয় তার নতুন ভর্তির জন্য? উত্তর, এত কথা বলে লাভ নেই, এটাই নিয়ম!
পাঠক, আপনারাই বলুন, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বা আরো উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রচলিত টিসি বিষয়ক এই নিয়ম গুলো কি আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত চরম অনিয়ম নয়? এই অনিয়ম রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কি কিছু করণীয় নেই?
লেখক: মো. রহমত উল্লাহ্ , শিক্ষাবিদ ও অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।