দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে সম্প্রতি অডিট দল তাদের নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। এই নিরীক্ষা চলাকালে বোর্ডের নানা অনিয়ম ঢাকতে অডিট দলকে সাড়ে ২১ লাখ টাকা ঘুষ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাজিউল ইসলাম।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ঘুষ লেনদেনের এই একটি বিষয় খোঁজ করতে গিয়ে একই অডিট দলের ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে ১২ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। আড়াই মাসের ব্যবধানে অডিটের নামে তিন শিক্ষা বোর্ড থেকে অডিট দলটি মোট সাড়ে ৩৯ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে বলে জানা গেছে।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলেন, বোর্ডের পরীক্ষার জন্য সাধারণত প্রতিবছর দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে খাতা কেনা হয়। তবে চলতি অর্থবছরের শুরুতে নিয়মবহির্ভূতভাবে এক দরপত্রেই একসঙ্গে পাঁচ বছরের খাতা কেনা হয়েছে। যার মূল্য ২১ কোটি ২৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এই দরপত্রে যতগুলো খাতা সরবরাহ করার কথা ছিল, তার সব সরবরাহ করতে হয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। কারণ, বোর্ডের ভান্ডারে আগেই জমা ছিল কিছু খাতা। নতুন খাতা ঠিক ততগুলোই কম ঢুকেছে। ওই টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে আত্মসাৎ করেছেন বোর্ড কর্মকর্তারা।
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর গত ৮ অক্টোবর প্রকাশিত অফিস আদেশে সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রাজশাহী ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের নিয়মানুগ নিরীক্ষার কথা জানায়। ১৫ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর চার কর্মকর্তার একটি অডিট দল শিক্ষা বোর্ডগুলো পরিদর্শন করবে বলে জানানো হয়। ওই অডিট দলে ছিলেন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ আলমগীর (দলনেতা), সহকারী পরিচালক সৌরভ হাসান (উপ-দলনেতা), এসএএস অধীক্ষক মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন (সদস্য) ও তানজির আলম (সদস্য)।
তবে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে নিরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে সামাজিক নিরাপত্তা অডিট বিভাগে বদলি হন অডিট দলের প্রধান মুহাম্মদ আলমগীর। পরে সেখানে স্থলাভিষিক্ত হন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের উপপরিচালক আতিকুল ইসলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৭ নভেম্বর বিকেল চারটায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডসংলগ্ন একটি সরকারি ব্যাংক থেকে শারমিন আক্তার রুম্পা নামের এক নারীর ব্যাংক হিসাবে ওই সাড়ে ২১ লাখ টাকা জমা হয়। ব্যাংক হিসাবে শারমিন আক্তারের ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, শুধু দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড নয়, একই অডিট দল গত ৩০ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে এবং ৩০ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে নিরীক্ষা কার্যক্রম করে। এর মধ্যে ৭ নভেম্বর ওই সরকারি ব্যাংকের ময়মনসিংহ বিজনেস সেন্টার শাখা থেকে ৬ লাখ টাকা এবং ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী করপোরেট শাখা থেকে ১২ লাখ টাকাসহ মোট সাড়ে ৩৯ লাখ টাকা ওই একই নারী শারমিন আক্তারের ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর বিকেল চারটা পর্যন্ত ওই নারীর ব্যাংক হিসাবে ২৫ লাখ ২৬ হাজার ৩৯৪ টাকা স্থিতি থাকার কথা জানা গেছে।
ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের সচিবের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব না হলেও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সচিব মো. হুমায়ুন কবির বলেন, অডিট চলাকালীন প্রতিনিধিদের জন্য স্বাভাবিকভাবে কিছু খরচ হয়, তবে কোনো ঘুষ দেয়া হয়নি।
মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি অডিট দলের প্রধান আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। সৌরভ হাসান আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করলেও ব্যাংক থেকে তাঁর স্বাক্ষরে টাকা স্থানান্তরের বিষয়টি তুলে ধরতেই একপর্যায়ে স্বীকার করেন।
সৌরভ হাসান জানান, দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে নিরীক্ষা শেষে মোট ২০টি বিষয়ে আপত্তি দেয়া হয়েছে। যে নারীর ব্যাংক হিসাবে অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে, সম্পর্কে তিনি খালাতো বোন বলে সৌরভ হাসান স্বীকার করেন। আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, 'বুঝেনই তো ভাই, এখানে অনেকেই আছেন।' তারপর আর কথা বাড়াতে চাননি সৌরভ হাসান।
এসব বিষয়ে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান স ম আব্দুস সামাদ বলেন, 'অডিটের বিষয়গুলো সাধারণত হিসাব শাখা দেখভাল করে থাকে। যে অভিযোগের কথা জানলাম, বিষয়গুলো তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'