একুশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধার বাইরে | বিশ্ববিদ্যালয় নিউজ

একুশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধার বাইরে

সরকারি ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধার বাইরে।

#বিশ্ববিদ্যালয় #শিক্ষার্থী

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় সবক’টি নিজস্ব ক্যাম্পাস ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭২। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৭টি। যার ২৮টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিগত ১৫ বছরে।

জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত নতুন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগেরই যাত্রা শুরু ভাড়া করা ভবনে। নতুন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগেরই যাত্রা শুরু ভাড়া করা ভবনে। এমনকি কয়েক দশক আগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাজনিত শঙ্কাসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, যা প্রভাব ফেলছে তাদের শিক্ষাজীবনেও।

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান আছে। এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা রয়েছে। এছাড়া ৯০ শতাংশের ওপর আবাসন সুবিধা রয়েছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে ৯৮ ও ৯৪ শতাংশ আবাসন সুবিধা রয়েছে। এছাড়া ৫০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত আবাসন সুবিধা আছে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশিষ্ট ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়েই আবাসন সুবিধা ৫০ শতাংশের নিচে।

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারি ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধার বাইরে।

বর্তমানে আবাসন সুবিধায় সবচেয়ে পিছিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ১৭ হাজার ৫২৭ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শুধু একটি ৭০০ আসনবিশিষ্ট হল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ হলে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকট নিরসনের দাবিতে দফায় দফায় আন্দোলন করলেও কোনো সমাধান মেলেনি। সর্বশেষ চলতি মাসে শিক্ষার্থীরা আবারো তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। দাবির মধ্যে ছিল আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে আবাসন বৃত্তি কার্যকর করতে হবে; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করেই অনুমোদন করতে হবে এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করতে হবে। আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠলে শুক্রবার সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়। সাতদিনের মধ্যে এ বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু বিগত সরকারের সময় যেভাবে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে, সেটি উচ্চশিক্ষার মানকে হুমকির মুখে ফেলেছে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক ক্লাসরুম-ল্যাবরুম, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা না করেই বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণের আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ে আবাসন সংকট অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলেও দীর্ঘ ২০ বছরেও তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি। গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠিত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই প্রধান ছিল। সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল কোনোমতে কার্যক্রম শুরু করা। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রেও যথাযথ পরিকল্পনা না থাকলে জগন্নাথের মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে সরকারের উচিত শিক্ষাবিদসহ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেয়া।’

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সুবিধা ৩০ শতাংশ বা তার কম। এগুলোর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ শতাংশ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে ৫, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, বাংলাদেশ মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা রয়েছে। আর চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যলয় ও পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো নিজস্ব ছাত্রাবাস নির্মাণ করতে পারেনি।

আবাসন সংকট রয়েছে দেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে আবাসন সুবিধা পাচ্ছে মাত্র ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সুবিধা আছে মাত্র ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণায় যথাযথ মনোযোগ দিতে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষত ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আবাসন সংকটের জেরে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাঝুঁকি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। কারণ বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই জেলা শহর থেকে দূরে। আশপাশের এলাকায় অধিকাংশ সময়েই শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত আবাসনের ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকে না। যে কারণে অনেক সময়ই শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জটিলতার মুখোমুখি হয়। স্থানীয়রা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব সংকটের অন্যতম কারণ বাজেট সংকট। সরকারের উচিত যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেগুলোয় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেয়া। উচ্চশিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধি করা। বিশেষত আবাসন সংকটের মতো বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করা উচিত।’

এদিকে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইনে শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে হোস্টেলের ব্যবস্থা করারও বিধান রয়েছে। তবে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিশাদ হোসেন বলেন, ‘আবাসন সংকটের কারণে আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকেন। মেস মালিকরা অনেক সময় সিন্ডিকেট করে ভাড়া বৃদ্ধি করে। আবার পর্যাপ্ত নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও নেই। নারী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই হয়রানির শিকার হন। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের হয়রানির জেরে স্থানীয়দের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।’

তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলছে, আবাসন সংকটের মূল কারণ সরকারের উদ্যোগের অভাব ও বাজেট সংকট। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘এ ধরনের বিষয়ে আসলে উপাচার্যের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। প্রজেক্ট পাস করা, বাজেট প্রদানের বিষয়টি সরকারের হাতে। আমরা প্রস্তাব দিতে পারি। কিন্তু সেক্ষেত্রেও যে খুব বেশি কিছু পাওয়া যায় এমন নয়। বিশেষত ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রজেক্টের বিষয়ে অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়েও যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই প্রজেক্ট পাস হওয়া নির্ভর করে সুপারিশ ও ক্ষমতার ওপর।’

সার্বিক বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ে আন্তরিক। বাজেট বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। সমস্যা সমাধানে আমাদের অবস্থান থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।

#বিশ্ববিদ্যালয় #শিক্ষার্থী