নতুন আনন্দে জেগে ওঠার বার্তা | মতামত নিউজ

নতুন আনন্দে জেগে ওঠার বার্তা

নববর্ষ বাঙালির শুদ্ধি ও সাধনার প্রতীক। বিশ্বকবি লিখেছেন, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা। অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।’ প্রকৃতির পালাবদলের মধ্য দিয়ে নতুন রূপ পরিগ্রহ করে বৈশাখ আমাদের সামনে হাজির হয়। জানান দেয় তার সজীবতা, স্বাচ্ছন্দ্যতা, শুদ্ধতা।

পহেলা বৈশাখ বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। বাঙালির প্রাণের উৎসবকে কেন্দ্র করে গ্রামে-শহরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে হাসি-আনন্দ আর ভালোবাসা। চৈত্র মাসের দাবদাহে যখন জনজীবন ক্লান্তশ্রান্ত তখন বাংলা বছরের প্রথম দিনটি সবার জীবনে নব-আনন্দে জেগে ওঠার বার্তা নিয়ে দুয়ারে কড়া নাড়ে।

প্রতিবছর বৈশাখের প্রথম দিন তথা বাংলা নববর্ষ প্রত্যেক বাঙালির জীবনে নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা-প্রেরণা-প্রত্যয়-স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়। নববর্ষের দিনটিতে আনন্দে মেতে ওঠে পুরো দেশ। ফেলে আসা দিনগুলোর জীর্ণতা ও পুরাতন সবকিছু পেছনে ফেলে নবউদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার অমিত শক্তি জোগায় এটি। নববর্ষের সর্বজনীনতা দিনে দিনে এটাকে বাঙালির প্রাণের উৎসবে রূপ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়েই পরিস্ফুট হয় বাঙালির আত্মপরিচয় ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। নববর্ষ বাঙালির শুদ্ধি ও সাধনার প্রতীক। বিশ্বকবি লিখেছেন, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা। অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।’ প্রকৃতির পালাবদলের মধ্য দিয়ে নতুন রূপ পরিগ্রহ করে বৈশাখ আমাদের সামনে হাজির হয়। জানান দেয় তার সজীবতা, স্বাচ্ছন্দ্যতা, শুদ্ধতা। অনেক আগে শুধু গ্রামে-গঞ্জে নববর্ষ পালিত হলেও দিনে দিনে শহরাঞ্চলেসহ সারাদেশে বিস্তৃত লাভ করেছে। এটি প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ে নতুন প্রেরণা নিয়ে হাজির হয়। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ।

বৈশাখ ষড়ঋতুর প্রথম মাস। নতুন বছর বরণের দিন গ্রামে গ্রামে মেলা বসে। নদীর ধারে, বট ও অশ্বত্থ বা প্রাচীন বৃক্ষকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে বৈশাখী মেলা। নববর্ষকে কেন্দ্র করে শহরেও নানা আয়োজন চোখে পড়ে। বছরের প্রথম দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার রমনার বটমূলসহ বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় উৎসব। ইলিশ আর পান্তা খাওয়ার ধুম পড়ে চারদিকে। নতুন সাজে, নতুন বেশে ছোটবড় সব বয়সীরা মেতে ওঠে আনন্দ উচ্ছ্বাসে।

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে প্রকৃতির এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফসল তোলার সময়কে কেন্দ্র করে বাংলা বঙ্গাব্দের উৎপত্তি। সম্রাট আকবরের সময়ে হিজরি অনুসারে কৃষকের কাছ থেকে ফসলের ও ভূমির খাজনা আদায় করা হতো। অসময়ে খাজনা পরিশোধ করতে কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হতো। সম্রাট আকবর সৌর ও হিজরি বর্ষ সমন্বয় করে কৃষকদের সুবিধার্থে বাংলা সন চালু করেন। এক কথায় প্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই বাংলা সনের উৎপত্তি। যুগে যুগে অগ্নি, পাহাড়, নদী, পৃথিবী, সূর্য, গাছ তথা প্রকৃতিকে বন্দনা করা হয়েছে। প্রকৃতিকে ছিন্ন করে আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান রক্ষা পেলেই পহেলা বৈশাখের মতো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষা পাবে। চৈত্রের শেষ দিন পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে চড়ক পূজা, লোকগান, খেলাধুলা, ভালো খাবার তৈরি, নতুন পোশাক পরিধান, হালখাতাসহ বিভিন্ন আয়োজন চোখে পড়ে। পহেলা বৈশাখে নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেসকো’ ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও এ বছর শোভাযাত্রার বদলে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ উদযাপন হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য-‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। নতুনভাবে উদযাপনে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি এবং ফিলিস্তিনের প্রতি বিভিন্ন সংহতি জানিয়ে থাকবে বিভিন্ন আয়োজন।

নববর্ষ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। নববর্ষ দিনে দিনে গড়ে ওঠা বাঙালি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধারণ করে নবজাগরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার দীক্ষা দেয়। নববর্ষ শুধু সকল কূপমণ্ডূকতা, অন্যায়, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অবিচার থেকে দূরে থাকতে শিক্ষা দেয় না, পাশাপাশি এসবের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদের মশাল জ্বালাতেও জাগ্রত করে। কিন্তু আমরা কি আমাদের মূল্যবোধ ও সততা দিয়ে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছি? কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মের বিরুদ্ধে নিয়ম প্রতিষ্ঠা করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদী ও নারী আজ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে মানুষ নামের কিছু অমানুষের দ্বারা। দখল-দূষণকারীদের দ্বারা নদী আর ধর্ষক-নিপীড়কদের দ্বারা নারীরা আজ অসহায়। প্রশ্ন জাগে, কেনো আমরা নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছি? কেনো আমরা দেশের সম্পদ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছি না? নারী ও শিশু নিগ্রহকারী, নির্যাতন ও ধর্ষণকারীরা আজ সমাজে সবার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই নববর্ষের প্রেরণায় সব অশুভ শুক্তির বিরুদ্ধে জাগ্রত হতে হবে।

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ যতোদিন থাকবে বাংলা সন ততোদিন ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে টিকে থাকবে। পহেলা বৈশাখের মতো অসাম্প্রদায়িক উৎসবের আবেদন কখনো কমবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে ইংরেজি খ্রিষ্টাব্দের চল বেশি তবুও বাংলা বঙ্গাব্দ কি ভোলা যায়! ষড়ঋতু যেভাবে আমাদের ঘিরে রেখেছে সেখানে বাংলা মাস ও বাংলার প্রকৃতিকে ভোলার সাধ্য কার।

লেখক: শিক্ষক