কামরুল হাসান মামুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেছেন, পিএইচডি কেবল একটি কারিগরি সনদ নয়, বরং জ্ঞানের গভীরে যাওয়ার একটি দার্শনিক যাত্রা। পিএইচডি হওয়া মানে কেবল বিশেষজ্ঞ হওয়া নয়—বরং একজন চিন্তাশীল মানুষ হয়ে ওঠা।
তবে আমাদের শিক্ষকরা পিএইচডি করতে যান কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে পিএইচডি ডিগ্রি না থাকলে প্রমোশন পেতে অসুবিধা হয়, শিক্ষক সমাজে মুখ দেখানো লজ্জার হয়ে উঠে।
পিএইচডি করে নামের সামনে ড. যুক্ত করতে পারলেই জীবনের শেষ স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মনে করে। আর আমাদের দেশে এখনো শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা হলো মাস্টার্স।
বিশ্ব এই ধারণা থেকে অনেক অনেক আগেই সরে এসেছে। ৫ আগস্টের পর ভেবেছিলাম এইসব দিকে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার এবং ইউজিসি সবাই আমাকে হতাশ করেছে।
শনিবার (২৮ জুন) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে অধ্যাপক মামুন এ মন্তব্য করে।
পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত নেচার জার্নালে একটা আর্টিকেল ছাপা হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল "Train PhD students to be thinkers not just specialists"! এই লেখাটি গত দুইদিন ধরে টাইমলাইনে ঘুরঘুর করছে তাই দুই কলম লিখতে ইচ্ছে করলো।
ইন ফ্যাক্ট লেখাটা জরুরি মনে হলো। বাংলাদেশের যত পিএইচডি ডিগ্রিধারী আছে তাদের মধ্যে কতজন সত্যিকারের thinker হতে পেরেছে। আজকের উচ্চতর শিক্ষার পেশাদার জগতে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই “PhD” শব্দটির পূর্ণরূপ—Doctor of Philosophy।
আপনি পদার্থবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান কিংবা অর্থনীতিতে পিএইচডি করুন না কেন—শিরোনামটি একই থাকে। এবং এই নামটি শুধু ঐতিহ্যের ধারক নয়, এটি একটি গভীর সত্যের বাহক: পিএইচডি হলো কেবল একটি কারিগরি সনদ নয়, বরং জ্ঞানের গভীরে যাওয়ার একটি দার্শনিক যাত্রা। নিচে একটা উদাহরণ দেই তারপর বাকি আলাপ।
যখন আমরা বলি, পিএইচডি মানে কেবল যন্ত্র বা সূত্র নয়, বরং চিন্তার সাহস—তখন ইতিহাস আমাদের এক অনন্য উদাহরণ উপহার দেয়: লুডভিগ বোল্টজম্যান।
তিনি ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। তার কণাগত গ্যাস তত্ত্ব ও এনট্রপির ধারণা আধুনিক পরিসংখ্যান বলবিদ্যার ভিত্তি গড়ে দেয়। কিন্তু বোল্টজম্যান শুধু একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না—তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ দর্শনের শিক্ষকও। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শনের ক্লাস নিতেন একটি বিশাল হলরুমে।
তার বক্তৃতাগুলো এতোটাই জনপ্রিয় ছিল যে শ্রোতারা কেবল আসনেই বসে থাকতেন না—অনেকেই দাঁড়িয়ে থাকতেন, এমনকি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেও তার কথা শুনতেন।
বিজ্ঞান ও দর্শনের এমন সার্থক মেলবন্ধন, এমন আবেগ ও বুদ্ধির সম্মিলন—আজকের দিনে বিরল। বোল্টজম্যান বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত বিজ্ঞানীকে শুধুমাত্র পরীক্ষণ বা গাণিতিক দক্ষতার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়।
তাকে জানতে হবে, তিনি কী নিয়ে কাজ করছেন, কেন করছেন, এবং তার কাজের দার্শনিক তাৎপর্য কী। তার কাছে দর্শন ছিল বিজ্ঞানকে গভীরভাবে বোঝার একটি অপরিহার্য মাধ্যম।
এই উদাহরণ থেকে আমরা বুঝলাম যে, পিএইচডি হওয়া মানে কেবল বিশেষজ্ঞ হওয়া নয়—বরং একজন চিন্তাশীল মানুষ হয়ে ওঠা।
একজন এমন ব্যক্তি যিনি কেবল সূত্র লেখেন না, বরং তার পেছনের বাস্তবতা ও ভাবনার দিগন্ত অনুসন্ধান করেন। যদি একজন বোল্টজম্যান একই সঙ্গে পদার্থবিদ ও দর্শনের শিক্ষক হতে পারেন, তাহলে আজকের পিএইচডি শিক্ষার্থী কেন কেবল কোড বা ডেটার ভেতরেই আটকে থাকবেন?
কিন্তু বাস্তবে, অনেক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি শিক্ষার্থীরা ক্রমশ রূপ নিচ্ছে শুধু যন্ত্র বা সফটওয়্যার চালনায় দক্ষ টেকনিশিয়ানে।
গবেষণার বাইরের চিন্তা, প্রশ্ন, দ্বিধা—এসবকে যেন নিরুৎসাহিত করা হয়। এই প্রবণতা পিএইচডি শিক্ষার প্রকৃত চেতনাকেই বিপন্ন করে তুলছে। নিঃসন্দেহে, গবেষণার কাজে বিভিন্ন সফটওয়্যার, অ্যালগরিদম, পরিমাপের যন্ত্র ও পরিসংখ্যানগত পদ্ধতির দক্ষতা জরুরি।
কিন্তু যদি পিএইচডি শিক্ষার পুরোটা কেবল এসব ‘টুল’ শেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠবে কর্মকার, কিন্তু চিন্তাবিদ নয়।
বিশ্ব এখন জটিল সংকটের মধ্যে—জলবায়ু পরিবর্তন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বৈষম্য, মহামারি। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন— ১) আন্তঃশৃঙ্খলাভিত্তিক দৃষ্টি, ২) নৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণের সক্ষমতা, ৩) জ্ঞানের অহং ত্যাগ করে সহনশীলতা। এইসব গুণ তৈরি হয় সমালোচনামূলক চিন্তা চর্চার মধ্য দিয়ে—not just toolkits.
পিএইচডি শিক্ষার্থীদের সাহস দিতে হবে প্রশ্ন করতে, সীমানা ছাড়িয়ে ভাবতে, এবং প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে। তাদের তৈরি করতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতায়, কেবল গবেষণার শ্রমিকে নয়।
বাংলাদেশে পিএইচডি প্রোগ্রামে কি এইসব চিন্তার যুক্ত আছে? এই চিন্তা ধারণ করে এমন শিক্ষক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কতজন আছে? আমাদের শিক্ষকরা পিএইচডি করতে যান কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে পিএইচডি ডিগ্রি না থাকলে প্রমোশন পেতে অসুবিধা হয়, শিক্ষক সমাজে মুখ দেখানো লজ্জার হয়ে উঠে।
একবার কোন শিক্ষক পিএইচডি করে নামের সামনে ড. যুক্ত করতে পারলেই জীবনের শেষ স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মনে করে। এইটা যেন না হয় সেইজন্যই বিশ্বের যত ভালো বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেখানে এন্ট্রি লেভেলে দরখাস্ত করতে ন্যূনতম শুধু পিএইচডি না বরং পিএইচডি-র পরে ২ বছরের অধিক পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতা চায়।
এই দুই বছরের অভিজ্ঞতা সময়ই প্রমাণিত হয় তার পিএইচডি ডিগ্রি কতটা সফল হয়েছে। সে কতটা thinker হতে পেরেছে। সে স্বাধীনভাবে নিজে নিজে গবেষণার আইডিয়া জেনারেট করতে পারে কিনা।
আর আমাদের দেশে এখনো শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা হলো মাস্টার্স। বিশ্ব এই ধারণা থেকে অনেক অনেক আগেই সরে এসেছে।
৫ আগস্টের পর ভেবেছিলাম এইসব দিকে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার এবং ইউজিসি সবাই আমাকে হতাশ করেছে।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিয়োগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।