জীবনে প্রতিটি সম্পর্কই এক একটি সফর। এটি কখনো স্নিগ্ধ বাতাসের মতো, কখনো আবার ভয়ংকর ঝড়ের আকারে আবির্ভূত হয়। আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলে সম্পর্ক গড়ে তুলি, সখ্যতা তৈরি করি এবং একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু জীবনের এই সম্পর্কগুলো যতো সুন্দর, ততোটাই ভঙ্গুর। সেগুলো ভেঙে ফেলার জন্য অনেক সময় তেমন কিছুই প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন শুধু একটি ভুল শব্দ, একটি অপ্রত্যাশিত মন্তব্য, কিংবা একটি অবহেলা। কথার শক্তি এমন যে, এক মুহূর্তের অসতর্ক শব্দও একটি সম্পর্কের মর্মস্থলে গভীর দাগ রেখে যেতে পারে, যা অনেক সময় সেরে ওঠা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিটি সম্পর্কের শুরু এবং তার পরবর্তী বিকাশের জন্য ভাষার ভূমিকা অপরিসীম। সম্পর্কের নিচে যে শক্তি কাজ করে তা হলো বিশ্বাস ও আন্তরিকতা। কিন্তু কথাই হলো সেই ভাষা যার মাধ্যমে এই বিশ্বাস ও আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। কথার মাধ্যমে আমরা অন্যজনের প্রতি আমাদের অনুভূতি, ভালোবাসা বা দুঃখ প্রকাশ করি। কিন্তু কথার শোভা বর্ধন বা অবমূল্যায়ন সম্পর্কের অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর যেমন প্রভাব ফেলতে পারে, তেমনি সেই শক্তি যদি অন্যভাবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে সম্পর্ক দ্রুত খাদের কিনারে চলে যেতে পারে। তাই বলা হয়, কথার আঘাতেই সম্পর্ক তার গতিপথ বদলায়।
আমরা প্রায়ই হয়তো ছোটখাটো কথা বলে থাকি, যা সরাসরি আমাদের চেতনা কিংবা আবেগের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কিন্তু কখনো কখনো, সেই সাধারণ এবং অবহেলিত কথাগুলোই একটি গভীর আঘাত হয়ে অন্যজনের অন্তরে বাসা বেঁধে যায়। বিশেষ করে যখন সম্পর্কের মধ্যে কোনো ধরনের অস্থিরতা বা মানসিক চাপ থাকে, তখন এই শব্দের ক্ষতি অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। কথার আঘাত হতে পারে এমন কিছু, যা একজন মানুষের আত্মবিশ্বাসকে নষ্ট করে, তার স্বাভাবিক জীবনধারা বাধাগ্রস্ত করে ও মাঝে মাঝে পুরো সম্পর্কটাই ভেঙে যায়।
ধরুন, কোনো ব্যক্তি তার প্রিয়জনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে চাচ্ছে। কিন্তু ভুল মুহূর্তে বলা একটি ছোট্ট মন্তব্য, যা অপর পক্ষকে অবহেলিত বা খাটো মনে করতে বাধ্য করে, সেই সম্পর্কের ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কথার মধ্যে এক ধরনের বিষাক্ত প্রভাব থাকে যা সহজে সৃষ্ট হতে পারে, কিন্তু সেই প্রভাব মুছে ফেলা অনেক কঠিন। যখন একে অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা থাকে, তখন সম্পর্কের ভেতরে একটি নির্দিষ্ট রকমের বন্ধন থাকে। কিন্তু এই বন্ধন একেবারে ক্ষীণ হয়ে যেতে পারে যদি আমরা কথা বলার সময়ে নিজের আবেগের কাছে হার মানি।
তবে এর বিপরীতও সত্য। যখন সম্পর্কের মাঝে বিশ্বাস ও সম্মান থাকে, তখন যেকোনো ধ্বংসাত্মক শক্তিকে একসঙ্গে উত্তেজনা বা মিষ্টতা দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব। একটি সদয় শব্দ, একটি আন্তরিক বাক্য, কিংবা কোনো সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা-এসব সম্পর্কের মাঝে শীতলতা ও দূরত্ব দূর করে দেয়। মানুষ যখন একে অপরকে পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করে এবং একে অপরের দুঃখ, কষ্ট ও হতাশাকে বুঝে সহানুভূতিশীল হয়, তখন সম্পর্ক আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই বলা যায়, একটি সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে বা সেটি ভেঙে যেতে সাহায্য করার জন্য মূলত আমাদের কথার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সম্পর্কের গতিপথ বদলে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো, মাঝে মাঝে সম্পর্কের ভেতরে থাকা মানুষরা নিজেদের শব্দের মাধ্যমে যেভাবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে, তেমনই সেই শব্দের শক্তি সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। যখন একজন ব্যক্তি তার ভাষা দিয়ে অন্যজনকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে, তখন সেই সম্পর্কের ভিত আরো মজবুত হয়। অন্যদিকে, যখন কেউ অন্যকে তুচ্ছ, ছোট, অথবা অসম্মানিত অনুভব করায়, তখন সেই সম্পর্কের শেকল দুর্বল হয়ে পড়ে।
এখানে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের শব্দের মানসিক ও শারীরিক প্রভাব সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন থাকা। আমাদের অনেক সময়ই মনে হয়, ‘একটা কথা তো কিছুই নয়’, কিন্তু এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন আমরা বুঝতে পারি, একটি একক শব্দ, এমনকি একটি একক বাক্য, সম্পর্কের ভিত পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিতে পারে। জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, আমরা একে অপরকে কীভাবে কথা বলি। কীভাবে আমাদের শব্দে শক্তি আসে এবং কীভাবে সেগুলো সম্পর্কের মধ্যে গতি আনে।
এই সত্যটি উপলব্ধি করা যে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের কথাই সবকিছু নয়, বরং কীভাবে এবং কখন কথা বলি সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় সঠিক সময়ে বলা একটি কথা, সঠিক জায়গায় বলা একটি বাক্য, সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করে দেয়। আবার অনেক সময়, অবহেলায় বলা একটিই শব্দ সম্পর্কের ভেতরে তৈরি করে দেয় বড় এক ফাটল। তাই, সম্পর্কের সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার জন্য আমরা যে কথাগুলো ব্যবহার করি, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সম্পর্কের মাঝে কথার শক্তি যতোটা প্রভাবিত করে, ততোটাই সম্পর্কের গভীরতা সৃষ্টি করে। একটি সম্পর্কের ভিত মজবুত থাকে তখনই, যখন সে সম্পর্কের মাঝে সদয় শব্দের ব্যবহার থাকে, সম্মানের পরিসর থাকে এবং সব কিছুতেই আন্তরিকতা থাকে। তাই, আসুন আমরা আমাদের প্রতিদিনের কথার প্রতি সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাই। কারণ, এই শব্দের শক্তিতেই লুকিয়ে থাকে সম্পর্কের আসল রূপ।