শিশুর মাঝে শিক্ষার ভিত গড়ে তোলার প্রধানতম দায়িত্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। সে কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের বিষয়ে জোর দিয়ে আসছেন শিক্ষাবিদরা। এবারের বাজেটে প্রশিক্ষণ খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রায় ৮৬ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রায় ৮৬ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ ছিল ৬২৮ কোটি ৬০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা আর আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৯১ কোটি ৭ লাখ ২৯ হাজার টাকা, যা বিগত বছরের তুলনায় ৫৩৭ কোটি ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বা ৮৫ দশমিক ৫১ শতাংশ কম। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ কমিয়ে ৪১৫ কোটি ৯১ লাখ ৪ হাজার টাকা করা হয়েছিল। সে হিসেবে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ কমছে ৭৮ দশমিক ১০ শতাংশ।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম বড় সংকট দক্ষ শিক্ষকের। প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ কমার ফলে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণে দক্ষ শিক্ষক তৈরির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিইডিপি-৪ প্রকল্প শেষ পর্যায়ে থাকায় ও অতিরিক্ত ব্যয় বাদ দেয়ায় বরাদ্দ কমেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘বাজেটে সবসময়ই শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়ার দাবি করা হয়, টাকার অংকে বরাদ্দ বাড়ানো হয়। কিন্তু আসলে সবই শুভঙ্করের ফাঁকি। শিক্ষার মান উন্নয়নে যে পদক্ষেপ দরকার সে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয় না। এবারের বাজেটও ব্যতিক্রম নয়। বিশেষত প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় বরাদ্দ কমানো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ প্রাথমিক ও গণশিক্ষাই শিক্ষার ভিত্তি তৈরি করে। এ স্তরে আমাদের দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি দূর করতে শিক্ষকদের মানসম্মত, উন্নত প্রশিক্ষণ দরকার। এমন পরিস্থিতিতে যদি এ খাতে বরাদ্দ আরো কমানো হয় তবে সেটি বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষায় এর আগে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল সেখানে দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়সহ নানা অভিযোগ ছিল। এ কারণে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে বরাদ্দ কমালেই দুর্নীতি কমবে এমনও নয়। আমাদের সারা দেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষক রয়েছেন, তাদের মানসম্মত প্রশিক্ষণে এ অর্থ যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সরকারের উচিত ছিল এ খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়ে মনিটরিং ও জবাবদিহি নিশ্চিতের মাধ্যমে মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।’
শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক আছেন ৬ লাখ ৫০ হাজার ২৯৩ জন। তাদের মধ্যে পেশাগত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোট ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৭ জন। অর্থাৎ মোট শিক্ষকদের অর্ধেকের বেশি এখনো পেশাগত প্রশিক্ষণের বাইরে। এছাড়া শিক্ষকদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৬৭ হাজার ৯৬৫ জন। শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৬৭ হাজার ৮২৬ জন।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান শাহীন বলেন, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণ জরুরি। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই নানা দাবি জানিয়ে আনছি। যেমন এখন প্রাথমিক শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রতি দুই-তিন বছর পর পর হয়। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ প্রতি বছর অন্তত একবার হওয়া উচিত। এছাড়া শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। এ কারণে সব শিক্ষকের আইসিটি প্রশিক্ষণও জরুরি। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম অন্তর্বর্তী সরকার এসব প্রশিক্ষণের বিষয়ে ইতিবাচক উদ্যোগ নেবে। এর পরিবর্তে যদি প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ কমানো হয়, তবে প্রাথমিক শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এদিকে দেশে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষকদের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমানে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) অধীনে ৬৭টি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই) রয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এ প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। তবে এ পিটিআইগুলোয়ও দীর্ঘদিন ধরে ইনস্ট্রাক্টর সংকট, কারিকুলামসহ বিভিন্ন সংকটের কারণে দীর্ঘদিন মৌলিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া বিগত সরকারের সময়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও শিক্ষকদের জন্য আইসিটি প্রশিক্ষণ, বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, চাহিদাভিত্তিক সাব-ক্লাস্টারসহ বেশকিছু প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এসব প্রশিক্ষণের বেশির ভাগেই অর্থ লুটপাট হয়েছে। ফলে মানসম্মত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত হয়নি, শিক্ষকদের ঘাটতি থেকে গেছে।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এর আগে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-৪ (পিইডিপি) এ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ ছিল। এখন এ প্রকল্প প্রায় শেষের দিকে। পিইডিপি-৫ এখনো শুরু হয়নি। এছাড়া বিগত সরকারের সময় প্রশিক্ষণে অনেক লুটপাটের অভিযোগ আছে। এ কারণেও এ খাতে বরাদ্দ কমতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, শিক্ষায় বরাদ্দ এবারো অপ্রতুল। বরাদ্দের বড় অংশই ব্যয় হবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বেতনভাতা দিতে। শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে উন্নত প্রশিক্ষণের মতো বিষয়গুলোয় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও বরাদ্দ নেই। শিক্ষার উন্নয়ন করতে চাইলে অবশ্যই এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষায় প্রশিক্ষণ জরুরি, তবে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ তার চেয়েও বেশি জরুরি জানিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিশেষ করে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের মারাত্মক সংকট আছে। সবার আগে এ সংকট দূর করা প্রয়োজন। আর প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বিগত সময়ে আমরা স্বচ্ছতা, জবাবদিহির বড় ঘাটতি দেখেছি। অনেক প্রশিক্ষণে প্রয়োজনের কয়েক গুণ বেশি অর্থ ব্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে বিগত সময়ে টাকার অংকে অনেক বেশি বরাদ্দ দেখা গেলেও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কতটা কাজে লেগেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এসব কারণে বর্তমান সরকার এ খাতে বাড়তি বরাদ্দ কমাতে পারে। আমরা আশা করব সরকার শিক্ষক সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানা এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামানের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।