প্রতীকী ছবি
বছর ঘুরে আবারও আলোচনায় বজ্রপাত। এ বছর এপ্রিল মাস থেকেই বজ্রপাতের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়েছে। বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মার্চের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়েছে। গত বছর বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা ছিলো ২৯৭। বেসরকারি গবেষণার তথ্য বলছে, গত এক দশকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যুর কারণ বজ্রপাত। বেশ কয়েক বছর ধরে ঝড়, বন্যা, ভূমিধসে মৃত্যু কমানো সম্ভব হলেও বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে।
বজ্রপাত যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেহেতু বজ্রপাত নিরোধ করা সম্ভব না হলেও মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই পদ্ধতি মৃত্যু কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে। বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হলো তাপপ্রবাহ ও লঘুচাপ। দক্ষিণের গরম বাতাস ও পশ্চিমের লঘুচাপের কারণে বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। মেঘের মধ্যে থাকা ঋণাত্মক ও ধনাত্মক চার্জের গঠন আর পরিবহনের ফলে বজ্রপাত নেমে আসে।
ঝড়-বৃষ্টি হলেই দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণের কথা বললেই প্রথমেই আসবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা। বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির ফলে বজ্রমেঘের এলাকার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে নাইট্রোজেন বেশি গ্রহণ করছে মেঘ। তাছাড়া পরিবেশ দূষণ, বৃক্ষসম্পদ ধ্বংস, নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ তো রয়েছেই। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়ার এমন অনভিপ্রেত পরিবর্তন বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টির জন্য বেশি দায়ী। মে-জুন মাসে ঝড়-বৃষ্টিসহ বজ্রপাত বেশি দেখা যায়। কেনোনা এ সময় বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা আর্দ্র বায়ু আর উত্তরের হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে ব্যাপক বজ্রঝড়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত কয়েক দশকের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, বিশ্বে বজ্রপাতের কারণে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার চারভাগের একভাগ মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান থেকে বজ্রপাতে বাংলাদেশে মৃত্যু বেশি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ১০ বছরে দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেছে ২ হাজার ৭০০ জনের।
সাধন সরকার। ছবি : দৈনিক শিক্ষাডটকম
বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে সরকার বজ্রপাতকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে বজ্রপাত রোধে নেয়া হয় বিশেষ পরিকল্পনা ও সতর্কীকরণ কর্মসূচি। কিন্তু মৃত্যুর মিছিল তাতে থামানো যায়নি। বজ্রপাতে প্রাণহানি রোধে তালগাছ রোপণের কথা বেশ জোরেশোরে প্রচার করা হয়। কিন্তু সেখানেও রয়েছে অপরিকল্পনার ছাপ। রাস্তার দু’ধারে তালগাছ রোপণ করলেও কাজে আসেনি। মাঠের মধ্যেও তালগাছ রোপণ করা দরকার ছিলো।
পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশে বাংলাদেশের থেকে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি হলেও সেসব দেশে মৃত্যুর সংখ্যা নগণ্য। তাল, নারিকেল, বট, সুপারিসহ নানা ধরনের বড় বড় গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নেয়। ফলে বজ্রপাত হলেও মানুষ বেঁচে যেতো। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গাছ কমে যাওয়াসহ কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও মুঠোফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি বজ্রপাত বাড়িয়ে দিচ্ছে! প্রশ্ন হতে পারে, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই কেন বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানোর ব্যাপারে কর্মপরিকল্পনা করা হয় না? বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মারা যায় কৃষক ও জেলেদের মতো পেশায় নিয়োজিত খেটে খাওয়া গরিব মানুষেরা। সরকারি তথ্য মতে, বজ্রপাতে মারা যাওয়া ৬৮ শতাংশই কৃষক।
এখন গৃহবধূ, শিশু, স্কুলছাত্র ও বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি মারা যাওয়া কৃষক ও জেলে পেশার দুই জনগোষ্ঠীকে বজ্রপাতের মৌসুম শুরুর আগে থেকেই যদি সচেতন করা যায় তাহলে বজ্রপাতে প্রাণহানি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই কেন কৃষক ও জেলেদের সচেতনতার ওপর জোর দেয়া হয় না ? এছাড়া প্রতিবছর বজ্রপাতে প্রচুর গবাদিপশুও মারা যায়। এপ্রিল বা এরপরের সময়টাতে বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটবে এটা তো কয়েক বছর ধরেই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতিবছর বজ্রপাতে ব্যাপক প্রাণহানির পরই কেবল কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। কৃষক খেতে কাজ করবে, জেলে মাছ ধরবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ঝড়-বৃষ্টির ওই সময়টুকুতে কৃষক-জেলেরা যাতে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে সে ব্যাপারে যেসব এলাকায় বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে সেসব এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে তালগাছ লাগানো একটা ভালো সমাধান। তবে এটা বেশ সময়সাপেক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। প্রযুক্তিগত সহায়তার কথা এক্ষেত্রে ভাবা যেতে পারে। গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রযুক্তির কথা আলোচনা হচ্ছে।
এর একটি হলো, বজ্রপাত অঞ্চলে মুঠোফোনের টাওয়ারে লাইটনিং অ্যারেস্টার (বজ্রনিরোধক দণ্ড) লাগিয়ে ঝুঁকি কমানোর বিষয়টি। এছাড়া রয়েছে গাণিতিক মডেল ও স্যাটেলাইটের ডাটা বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া। আবার কোটি কোটি টাকার বাজেট নিয়ে বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা মৃত্যু রোধ করতে পারছে না। বলা হচ্ছে, হাওর-বাঁওর এলাকার ফসলের মাঠে নির্দিষ্ট দূরত্বের পরপর এই যন্ত্র বসালে বজ্রপাত হওয়ার আগে তথ্য পাওয়ার মাধ্যমে বজ্রপাতে মৃত্যুহার অনেক কমে আসবে। কোথায় কখন বজ্রপাত হতে পারে, ওই প্রযুক্তির সাহায্যে ৪০ মিনিট আগেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় মুঠোফোনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানা সম্ভব। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিনির্ভর এই ‘লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর’ কাজে লাগাচ্ছে। যদিও এই প্রযুক্তিতে ব্যয় একটু বেশি।বজ্রপাত যেহেতু প্রাকৃতিক, এটা হবেই, তবে কম অথবা বেশি। বজ্রনিরোধক দণ্ড বা তালগাছ রোপণ যে ব্যবস্থায় গ্রহণ করা হোক না কেন প্রতিবছর বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তাই সচেতনতাই একমাত্র সমাধান। বজ্রপাত রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে। আবার শহরে ও গ্রামে বিল্ডিংয়ে বজ্রনিরোধক দণ্ড বা বিভিন্ন স্থানে ধাতব টাওয়ার বসানোর মাধ্যমেও বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানো সম্ভব।
যেহেতু হাওর এলাকায় বজ্রপাত বেশি হচ্ছে সেহেতু সেখানে তালগাছ, বড় গাছ লাগানো ও বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড স্থাপনে জোর দিতে হবে। এককথায়, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিলে ব্যাপক প্রাণহানি রোধ করা সম্ভব- ১. যেসব এলাকায় বেশি প্রাণহানি হয় সেসব এলাকায় ব্যাপক পরিসরে কৃষক ও জেলেদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ২. তাল গাছ ও বড় গাছ রোপণ কার্যক্রমে গুরুত্ব দিতে হবে। ৩. ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও প্রযুক্তিগত সহায়তা কাজে লাগাতে হবে।লেখক: শিক্ষক