আজ ১৭ জুন বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ থেকে খরা ও মরুকরণে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে কেনিয়ার নাইরোবিতে বিশ্ব মরুকরণবিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
গঠিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মরুকরণ প্রতিরোধ কনভেনশন’। এরপর ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে এ কনভেনশনের আলোকেই জাতিসংঘ একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তুলতে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিবছর ১৭ জুন ‘খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হয়। বাংলাদেশেও ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে খরা ও মরুময়তা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
পৃথিবীতে ১১ ধরনের খরা দেখা যায়। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ খরা হলো আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট খরা। খরার সৃষ্টির প্রধান কারণ দুইটি। এক. প্রাকৃতিক ও দুই. মনুষ্যসৃষ্ট। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট এল নিনোর প্রভাব, কম বৃষ্টিপাত, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া ও ভূমিক্ষয়।
মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- বন উজাড়, অতিরিক্ত চাষাবাদ, অধিক জনসংখ্যা, মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, পানি রাজনীতি ইত্যাদি। মানবসৃষ্ট কারণগুলো পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক কারণগুলোর ওপর খরা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। সে হিসেবে বলা যায়, মানবসৃষ্ট কারণই খরার জন্য দায়ী। খরা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য হুমকি তৈরি করে।
খরাকে জলবায়ুর একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বলা হলেও জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে এটি এখন মহাদুর্যোগ হয়ে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীতে বর্তমানে খরা সংক্রান্ত দুর্যোগের পরিমাণ প্রায় ১৫ শতাংশ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্য বলছে, ১৯৭০ থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শুধু খরার কারণে প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি মানুষ।
জাতিসংঘের ভবিষ্যৎবাণী বলছে, ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে খরা বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশের মানুষকে প্রভাবিত করবে। সবমিলিয়ে প্রতিবছর খরার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫৫ মিলিয়ন মানুষ। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিবছর খরার কারণে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়। কোটি কোটি মানুষকে পুষ্টিহীনতায় ভুগতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ খরার প্রভাবে ভুগতে থাকা একটি বদ্বীপ। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের জেলাসমূহ খরাপ্রবণ এলাকার মধ্যে অন্যতম।
একটা সময় বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের জেলাসমূহে বিশেষ করে নওগাঁ, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ বছরের অর্ধেক সময় খরার প্রভাবে ভুগতো। কিন্তু সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু খরার ঝুঁকি কাটেনি। বাংলাদেশে খরার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ ২২ বারের মতো খরার মুখোমুখি হয়েছে। প্রতি আড়াই বছর পরপর বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ ও পরোভাবে খরার মুখোমুখি হয়। খরার কবলে পড়ে ফসল উৎপাদন হ্রাস পায় এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সারাদেশে।
বাংলাদেশের খরার প্রধান কারণ দীর্ঘমেয়াদি শুষ্ক আবহাওয়া ও কম বৃষ্টিপাত। নারী ও শিশুদের ওপর খরার প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ শিশু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে খরার প্রভাবের শিকার। খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্নআয়ের পরিবারগুলো। খরা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে কৃষকেরা সেচ কাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে থাকে।
মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্থর নিচে নেমে যায়। যার পরোক্ষ কারণে মরুকরণ ত্বরান্বিত হয়। বাংলাদেশে জলাভূমি ভরাট আইন থাকলেও তা মানা হয় না। সবাই যেনো বন-পাহাড়-নদী-জলাভূমি ধ্বংস করে টাকা উপার্জনে ব্যস্ত। নদীমাতৃক বাংলাদেশে দেশের জলাভূমি রক্ষা পেলে মরুকরণের সম্ভাবনা তৈরি হতো না। খরা ও মরুকরণের প্রভাবে ফলস উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে একদিকে খাদ্য উৎপাদন কম হচ্ছে অপরদিকে মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়ছে খাদ্যের।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে প্রতিবছর বিশ্বের দুই বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা মরুকরণ হচ্ছে। খরার প্রধান লক্ষণ হলো মাটির উর্বরতা হ্রাস ও পানির স্বল্পতা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে খাদ্যর চাহিদা বাড়ছে। বিপরীতে জলবায়ু পরিবর্তনের নানাবিধ সংকটে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। উন্মুক্ত জলাধার ও নদনদীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সবমিলিয়ে মানুষ্যসৃষ্ট প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড মরুকরণের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। খরার কারণে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা, দারিদ্র্য ও পরিবেশগত নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
এখন বেশি দরকার খরা ও মরুকরণে রোধে সচেতনতা। খরা থেকে বাঁচতে পানির ন্যায্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তৃণভূমি ও বনভূমি সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম জলাধার তৈরি, জলাভূমি সংরক্ষণ, উজানে পানি ব্যবস্থাপনা, আন্তঃসীমান্ত পানির সুব্যবস্থাপনা খরা ও মরুকরণ রোধে সহায়ক হতে পারে।
লেখক: শিক্ষক