অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে মাঠপর্যায়ে প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনের জন্য একটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে গাড়িটি কেনা হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য।
টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়িটি প্রয়োজন না থাকলেও অতিরিক্ত মূল্যে গাড়ি কেনায় প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঊর্ধ্বতনদের খুশি করতেই এত বেশি দামে গাড়িটি কেনা হয়েছিল।
মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের এক নিরীক্ষায় বাপেক্সের আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তর নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা এবং সচিবসহ সব কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠানের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সচল গাড়ি থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজন ব্যতীত অতিরিক্ত মূল্যে জিপ গাড়ি কেনায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় গাড়িটি কেনে বাপেক্স। এ জন্য গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দরপত্র আহ্বান করে প্রতিষ্ঠানটি। দরপত্রে অন্য কেউ অংশ না নেওয়ায় নাভানা লিমিটেডের সঙ্গে একই বছরের এপ্রিলে চুক্তি হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের ৩০ দিনের মধ্যে ১০ শতাংশ অগ্রিম অর্থ পরিশোধের শর্ত দেওয়া হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, গ্রেড-১ এবং গ্রেড-২ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য অনূর্ধ্ব ২ হাজার ৭০০ সিসি গাড়ি কেনার জন্য ভ্যাট ট্যাক্স এবং নিবন্ধনসহ ১ কোটি ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে নাভানা লিমিটেডের কাছ থেকে জিপ গাড়িটি ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় কেনা হয়। সেই হিসাবে এই বিলাসবহুল গাড়ি কেনায় বাপেক্সের ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেনারেল ম্যানেজার, সচিবসহ সব কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠানের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সচল গাড়ি রয়েছে। সেই হিসেবে তাদের জন্য গাড়ি প্রয়োজন নেই। এরপরও অতিরিক্ত মূল্যে নতুন মডেলের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো জিপ গাড়িটি কেনা হয়। ২ হাজার ৭৫৫ সিসির গাড়িটির মডেল জিডিজে২৫০আরজিএনজেডআরওয়াই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অধিকমূল্যে গাড়ি কেনার পর সমালোচনার মুখে পড়ে বাপেক্স। এ কারণে চুক্তির পরও নাভানা লিমিটেডের কাছ থেকে গাড়ি বুঝে নিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। কার্যাদেশ দিয়েও গাড়ি না নেওয়ায় বারবার তাগাদা দিচ্ছে নাভানা। কিন্তু সরকার পতনের পর অধিকমূল্যের এ গাড়ির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না বাপেক্সের কর্মকর্তারা। ফলে দীর্ঘদিন ধরে গাড়িটি নাভানার শোরুমে পড়ে আছে।
গাড়ি বুঝে নিতে নিজেদের মধ্যে চিঠি চালাচালি করছেন বাপেক্সের কর্মকর্তারা। এমন একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গাড়িটি বর্তমানে নাভানা লিমিটেডের গোডাউনে সংরক্ষিত আছে। সরেজমিন পরিদর্শন করে ক্রয়াদেশ অনুযায়ী সরবরাহকৃত গাড়ি যাচাই-বাছাই করে গত ১৬ অক্টোবর মান পরিমাপক সনদ দেয় নির্ধারিত কমিটি। পরবর্তী সময়ে ১৫ নভেম্বর বাপেক্সের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কাগজপত্র, খুচরা যন্ত্রাংশ, চাবিসহ গাড়িটি গ্রহণ করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত চাহিদাকারী সেবা উপবিভাগ গাড়িটি গ্রহণ করেনি। এমন অবস্থায় বিষয়টি অতীব জরুরি উল্লেখ করে গাড়িটি জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণের জন্য ফের অনুরোধ করা হয়।
বাপেক্স সূত্র বলছে, প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকায় গাড়িটি কেনা হয় উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায়, কাজ পায় একটি বেসরকারি কোম্পানি। গাড়িটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসের আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর বেশ কিছুদিন গাড়িটি বন্দরে পড়ে ছিল। গাড়ি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে সময় নেয় বাপেক্স। এরপর সরবরাহকারী কোম্পানির চাপে গাড়িটি বন্দর থেকে ঢাকায় আনা হয়। গাড়িটি নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রশাসন বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। পরে প্রশাসন বিভাগের সেবা উপবিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, অডিটের বিষয়টি জানা নেই। গাড়িটির বিষয়ে কী হবে এটা নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত না হওয়ায় কোম্পানি বারবার তাগাদা দিলেও গাড়ি বুঝে নেওয়া যাচ্ছে না।
জানা যায়, গত ২৮ জানুয়ারি ২৭৫৫ সিসির একটি জিপ গাড়ি কেনার অনুমোদন হয় বাপেক্সের বোর্ড সভায়। এটি উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে কেনার কথা বলা হয় সভায়। গাড়িটি কিনতে প্রাক্কলিত দর অনুযায়ী ৫ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট থেকে বরাদ্দ অনুমোদন করে বাপেক্সের পরিচালনা পর্ষদ।
বাপেক্সের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. আসাদ উল্লাহ ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব স্বাক্ষরিত বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের লক্ষ্যে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা মাঝেমধ্যে মাঠপর্যায়ে যাতায়াত করেন। মানসম্মত গাড়ি না থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাড়ি সরবরাহ সম্ভব হয় না। তাই তাদের ব্যবহার উপযোগী একটি গাড়ি কেনা দরকার।
বাপেক্সের অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামোতে ২৫টি জিপ গাড়ি ও ৭০টি সেডান কারের সংস্থান রয়েছে। কোম্পানিতে বিদ্যমান জিপ গাড়িগুলোর মধ্যে ১০ বছরের বেশি পুরোনো ও মেরামত অযোগ্য ৩টি জিপ নিলামে বিক্রির সুপারিশ করে ‘মালামাল অকেজো ঘোষণা কমিটি’ এবং এর বিপরীতে একটি উন্নতমানের জিপ গাড়ি কেনার কথা বলা হয়। কিন্তু এতগুলো গাড়ি থাকতে নতুন করে অধিকমূল্যের জিপ কেন কিনতে হবে, তাও কেবল প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য—এ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
বাপেক্স সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোর্ড সভায় অনুমোদনের পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তড়িঘড়ি করে গাড়ি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে পারচেজ অর্ডার দেওয়া হয়। যদিও মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনে এত ব্যয়বহুল গাড়ি কেনার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি কেনার কথা বলা হলেও মূলত সাবেক জ্বালানি সচিব ও বাপেক্সের সাবেক বোর্ড চেয়ারম্যান নূরুল আলমের ইচ্ছায় কেনা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তনের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। এ কারণে বর্তমান বাপেক্স কর্তৃপক্ষ এর দায় নিতে চাচ্ছে না। সূত্র: কালবেলা