এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অস্তিত্বহীন পটুয়াখালীর মৌকরণের দক্ষিণবঙ্গ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং ঝিনাইদহের আদর্শ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। তবু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ মানসম্পন্ন ও সমমানের সনদের দাবিদার টিটি কলেজের তালিকায় এদের নাম রয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত বছরের ৫ জানুয়ারি ওই তালিকা প্রকাশ করানো হয়। অভিযোগ উঠেছে কোটি কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে এমন এক উদ্ভট তালিকা প্রকাশ করেছিলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ও অধিভুক্ত হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা, সরকারি ও বেসরকারি অনুদান, স্কেল, পদোন্নতি এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা নেওয়া, ফল প্রকাশ, সিলেবাস ও প্রশ্ন তৈরি করা। আবার ডিগ্রি বা অনার্স লেভেলের কলেজে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে ভিসির প্রতিনিধি উপস্থিত থাকার বিধান থাকলেও এমপিওভুক্তি বা বেসরকারি খাতের বেতন-ভাতার বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ বা সুপারিশের এখতিয়ার নেই বিশ্ববিদ্যালয়টির। ফলে অনার্স-মাস্টার্স কলেজের হাজার হাজার শিক্ষক ত্রিশ বছর ধরে এমপিওর বাইরে। যদিও পতিত আওয়ামী লীগের দোসর ভিসি হারুন অর রশীদ ও মশিউর রহমান শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি ও স্কেল পাওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন গত দশ বছরের বেশি সময়। ফটো সেশন করেছেন অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক সমিতির নেতাদের সঙ্গে।
ননএমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক আকবর হোসাইন বলেন, যখনই আমরা যেতাম অধ্যাপক হারুন অর রশীদের কাছে তখনই তিনি বলতেন, শিক্ষাসচিব তার সাবেক ছাত্র, মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি তার পুরনো ছাত্র। এই তো ফোন করে বলে দিচ্ছি তোমাদের এমপিও হয়ে যাবে। এরপর ফটো সেশন হতো। আবার সেই খবর প্রকাশের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ শাখার কতিপয় নামধারী টিভি ও পত্রিকা ছিলো। সেখানে প্রকাশ হতে দেখে সারাদেশের শিক্ষকরা দোয়া করতেন হারুন ও মশিউরদের গংদের।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায় শুধু বিএড কলেজ নয় এমন অনেক প্রফেশনাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি, স্বীকৃতি, ভর্তিতে টাকার খেলা চলেছে গত ১৫ বছর। শিগগিরই শ্বেতপত্র প্রকাশ হচ্ছে। অস্তিত্বহীন কলেজের তালিকা প্রকাশে কত কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের নাম প্রকাশ করা হবে।
বিএড তালিকা জালিয়াতির বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগ বলা হয়, গত বছর হঠাৎ করেই বিএড কলেজের তালিকা প্রকাশের পেছনে বিএড সনদ ব্যবসায়ী ও ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগের নেতা ও এমপি নবী নেওয়াজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিয়ে যাওয়া ভিসি মশিউর রহমান, কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানা ও বিএড সনদ ব্যবসায়ী জনৈক নরজুল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। আরো ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আওয়ামী লীগপন্থী কর্মচারী নেতা কাবুল মোল্যাসহ কয়েকজন। তাদের সবার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা হয়েছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ দৈনিক সমকাল পত্রিকায় “শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি : বিএড স্কেল পাবেন ২৩ বেসরকারি টিটি কলেজের সনদধারী” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিএড স্কেল প্রত্যাশী শিক্ষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। তারা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, জনৈক নরজুল ও আওয়ামী নেতা-কর্মীর মালিকানাধীন কয়েকটি বেসরকারি টিটি কলেজ শিক্ষকদের বিভ্রান্তিতে রেখেছিলো গত কয়েকবছর। আরো বিভ্রান্তি তৈরি হয় গত বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ৯০টি টিটি কলেজের তালিকা প্রকাশের পর। তালিকায় সরকারি, বেসরকারি, অস্তিত্বহীন ও কয়েকযুগ আগে বন্ধ হওয়া সব কলেজের সনদের মান সমান বলা হয়। নরজুল ও নবী নেওয়াজ গং আরো ভুল ব্যাখ্যা করেন শিক্ষকদের কাছে। মান সমান আর স্কেল পাওয়া বা এমপিওভুক্ত হওয়া না হওয়া তো আলাদা। স্কেল না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন শত শত শিক্ষক। তারা ঘুরছেন শিক্ষা অধিদপ্তরগুলোর বারান্দায়। এবার ডজন খানের মামলা নিয়ে সাবেক ভিসি মশিউর ও এমপি নবী নেওয়াজ পলাতক।
এদিকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ দৈনিক সমকাল পত্রিকায় “শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি : বিএড স্কেল পাবেন ২৩ বেসরকারি টিটি কলেজের সনদধারী” শিরোনামের প্রতিবেদনটি হুবহু নিম্নরুপ:
সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (টিটিসি) এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সরকার অনুমোদিত মাত্র ২৩টি বেসরকারি টিটি কলেজ থেকে বিএড সনদ অর্জনকারীরা উচ্চতর স্কেল পাবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি চিঠিতে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই চিঠি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
২১ জানুয়ারির এ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল মামলা নং ৯৯/২০১৪ রায়ের আদেশ এবং কনটেম্পট পিটিশন নং ১৫৩/২০১৪ বহালের পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার মাধ্যমে রায়ের পূর্বে পিটিশনারদের ২৩টি কলেজের বিএড ডিগ্রি অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের বিএড স্কেল দিয়ে আসছে। এখন হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার মাধ্যমে ২৩টি কলেজের নামের তালিকা প্রকাশপূর্বক পত্র জারি করা প্রয়োজন।
তবে এই চিঠির ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অন্য বেসরকারি বিএড কলেজের সনদধারিদের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গত, ইতোপূর্বে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা বিভাগ (ডিআইএ) সরকারি টিটি কলেজ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সরকার অনুমোদিত ২৩টি বেসরকারি কলেজ থেকে বিএড সনদ অর্জনকারিদের উচ্চতর স্কেল দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। ভুয়া বিএড সনদ নিয়ে উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তির বিষয়টি তদন্তে ডিআইএ ঢাকার সবচেয়ে নামকরা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে অবাক করা তথ্য পান। সেখানে ৪৩ জন শিক্ষক বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড সনদ নিয়ে উচ্চতর স্কেল গ্রহণ করছেন বলে ডিআইএর তথ্যে উঠে এসেছে।
সরকার অনুমোদিত যে ২৩টি বেসরকারি টিটি কলেজের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো; হাজী ওয়াজেদ আলী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, সাতক্ষীরা; মহানগর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, আজিমপুর, ঢাকা; আমিরুল ইসলাম কাগজী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, পাইকগাছা, খুলনা; হাজীগঞ্জ আইডিয়াল কলেজ অব এডুকেশন, চাঁদপুর; পিরোজপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ; কলেজ অব এডুকেশন বিএড বরিশাল; মুন্সী মেহেরুউল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, যশোর; জয়পুরহাট বিএড কলেজ; মঠবাড়িয়া টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, পিরোজপুর; বগুড়া বিএড কলেজ; দক্ষিণ বঙ্গ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, পটুয়াখালী; কক্সবাজার টির্চাস ট্রেনিং কলেজ; পরশ পাথর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, চট্টগ্রাম; ড. মিয়া আব্বাস উদ্দীন টি.টি কলেজ, মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট; শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, পালবাড়ী, যশোর; উপশহর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, যশোর; মাগুরা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, এ জি একাডেমী, মাগুরা; খান টিচার্স ট্রেনিং কলেজ; সেকান্দার টিচার্স ট্রেনিং কলেজ; সিটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ; ন্যাশনাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ; কলেজ অব এডুকেশন বিএড নর্থ আমানত গঞ্জ; সিটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, চট্টগ্রাম।
এক প্রশ্নের জবাবে কলেজ শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, ভিসি মশিউরের নির্দেশে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তালিকার খসড়া তৈরি করেছিলেন নবী নেওয়াজ গং। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে নবী নেওয়াজসহ কয়েকজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আমলাদের কাছে তদবির করেছিলেন মর্মেও অভিযোগ রয়েছে। আমাদের শাখা থেকে শুধু তালিকাটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছি। টাকা লেনেদেনের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তবে, ৫ আগস্টের পর পলাতক আওয়ামী লীগের একজন সাবেক সংসদ সদস্য ও কয়েকজন সনদ ব্যবসায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ শাখার কর্মচারী ও দালালদের সঙ্গে ঘুরঘুর করতেন।