কুরবানি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। পবিত্র কোরআনে ঐতিহাসিক দুটো কোরবানির বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। আদম (আ.)-এর দুই সন্তানের কোরবানি ও ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি। কুরবানি সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব এবং ইসলামের মৌলিক বিধানগুলোর একটি। কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পাশাপাশি গরিব-দুঃখী ও প্রতিবেশীদের সাহায্য করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং ইসলামের অন্যতম প্রতীকী বিধান- ‘শাআইরে ইসলাম’-এর অন্তর্ভুক্ত। তাই মুসলমানদের জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম।
পূর্ববর্তী উম্মতের জন্য কোরবানির গোশত খাওয়ার বিধান ছিল না। তারা কোরবানি করে তা দূরে ফেলে দিয়ে আসত। এরপর তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হলে আসমান থেকে আগুন এসে জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। পবিত্র কোরআনের সুরা আলে ইমরানের ১৮৩ আয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। রাসুল (সা.)-এর উম্মতের জন্য কোরবানির গোশত খাওয়া হালাল করে দেওয়া হয়েছে। কোরবানির গোশত নিজে খাবে, পরিবারবর্গকে খাওয়াবে, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে হাদিয়া দেবে এবং গরিব-মিসকিনকে দান করবে।
তবে কুরবানি নিয়ে একটি প্রশ্ন অনেকের মনে ঘোরে- অমুসলিমদের কুরবানির মাংস দেওয়া যাবে কি না? বিশেষত বর্তমান সমাজে যেখানে মুসলমানদের প্রতিবেশী হিসেবে বহু অমুসলিম বসবাস করেন, সেখানে এই প্রশ্নটি বাস্তবতা বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক মুসলমান মনে করেন, কুরবানির মাংস কেবল মুসলমানদের মধ্যেই বণ্টনযোগ্য। তবে এই ধারণাটি সঠিক নয়। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে অমুসলিমদের- বিশেষ করে প্রতিবেশী, সহকর্মী কিংবা গরিবদের- কুরবানির মাংস দেওয়া সম্পূর্ণ বৈধ ও গ্রহণযোগ্য।
সাহাবিদের জীবনে এমন উদাহরণ রয়েছে যেখানে তারা অমুসলিম প্রতিবেশীদের কুরবানির মাংস দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে- আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)-এর বাড়িতে একটি বকরি জবাই করা হলে, তিনি বাড়ি ফিরে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীকে এই গোশত পাঠিয়েছ?
তিনি একাধিকবার এটি জিজ্ঞাসা করেন এবং বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি- জিবরাইল (আ.) আমাকে বারবার প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে উপদেশ দিতেন, এমনকি আমি ধারণা করতাম যে প্রতিবেশীকেও উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেওয়া হবে। (তিরমিযী, হাদিস : ১৯৪৩)
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, প্রতিবেশী মুসলিম না হলেও তার হক আছে এবং তাকে সদয়তা ও আপ্যায়ন দেওয়া ইসলামের শিক্ষা।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন : দ্বিনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। - (সূরা মুমতাহিনা, আয়াত ৮)
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, অমুসলিম যদি বৈরী না হয়, তবে তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, দান-খয়রাত এবং সামাজিক সৌহার্দ্য গঠন ইসলামসম্মত।
ইসলামের দৃষ্টিতে কুরবানির মাংস অমুসলিমদের দেওয়া জায়েজ (বৈধ)। বিশেষত যদি তারা প্রতিবেশী হয় কিংবা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তবে তাদের হক রয়েছে। কুরবানির মাধ্যমে যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়, তেমনি মানবিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহানুভূতি বৃদ্ধির সুযোগও তৈরি হয়।
অতএব, কুরবানির মাংস অমুসলিম প্রতিবেশী বা বন্ধুদের উপহার দেওয়া ইসলামসম্মত ও মানবিক কাজ। এটি ইসলামের সহনশীলতা ও সৌহার্দ্যেরই প্রতিফলন।