দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণে সরকারকে নাস্তানাবুদ করার সব পদক্ষেপ! পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রীদের পাঠ্যবই সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে এখনো বহাল তবিয়তে। ভারতে বই ছাপতে দেওয়ার কাজ পাইয়ে দিয়ে মোটা অংকের কমিশন এবার হাতছাড়া হয়েছে এই সিন্ডিকেটের। প্রতিশোধ নিতে পাঠ্যবই ইস্যুতে মধ্য জানুয়ারিতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মাঠে নামানোর পরিকল্পনা।
এদিকে অবৈধ নোট-গাইড কোম্পানি মালিক, পাঠ্যবইয়ের কতিপয় মুদ্রাকর, ভারতে বই ছাপানোর বাংলাদেশী এজেন্ট ও এনসিটিবিতে কর্মরত কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন অঘটন ঘটিয়ে চলছেন। এসব দেখেও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না এনসিটিবির নিয়ন্ত্রণকারী শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সব মিলে পাঠ্যবই নিয়ে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পাঠ্যবই সংশ্লিষ্ট ও শিক্ষাবিদরা এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষা পদ্ধতি তছনছ করা ও প্রশিক্ষণের নামে সরকারের শত শত কোটি টাকা গচ্ছা দেওয়ায় অভিযুক্ত অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী এখনও খুব চাতুর্যের সাথে সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করে চলছেন। বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট থেকে রবিউলকে গত জুলাই মাসে এনসিটিবিতে সদস্য হিসেবে নিয়ে আসেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। পরীক্ষা দেখার নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে অযথাই বিদেশ ঘুরেছেন রবিউল। ঘুরতে ঘুরতে স্ত্রী-সন্তানকেও বিদেশে সেটেল করিয়েছেন। নিজেও প্রশিক্ষণের নামে বেশিরভাগ সময় বিদেশে কাটিয়েছেন মর্মে অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারদের। এনসিটিবিতে এখন তিনি দুই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন।
সম্প্রতি অবৈধ নোট-গাইড কোম্পানির প্রভাবশালী ও আওয়ামী লীগপন্থী মালিকদের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের ফরমায়েশি তদন্ত প্রতিবেদন লিখে ধরা পড়েছেন রবিউল। দীপু মনি ও নওফেলের দাপটে সহকর্মী ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন মর্মে অভিযোগ সবার মুখে মুখে। সম্প্রতি পাঠ্যবই সংক্রান্তে একটা তদন্ত কমিটির কাজ চলাকালে ক্যাডারের সহকর্মীদের সঙ্গে ‘বেয়াদবি’ করার অভিযোগ উঠেছে রবিউলের বিরুদ্ধে।
অভিযোগে জানা যায়, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পরও রবিউলের আচরণে কোনো পরিবর্তন হয়নি। দীপু মনি ও এনসিটিবির সাবেক বিতর্কিত সচিব নাজমার সিন্ডিকেটের হয়েই কাজ করছেন। দুর্নীতির অভিযোগ থাকা নাজমাকে দুই মাস আগে ঢাকার বাইরে বদলির পর এনসিটিবিতে তাকে বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেন রবিউল। এনসিটিবিতে দীপু মনির পছন্দের ঠিকাদারদের বিলে সই করে চলছেন চোখ বন্ধ করে। এখনও কোটেশন টেন্ডারের কাজ পাচ্ছেন দীপু মনি ও নাজমার পছন্দের ঠিকাদাররাই। তারা সবাই চাঁদপুর ও মতিঝিল এলাকার যুবলীগ কর্মী। এত কিছুর পরেও এখনও বহাল তবিয়তে রবিউল। সঠিক ইতিহাস সংযোজিত পাঠ্যবই সঠিকভাবে ছেপে সময়মতো বিতরণ কার্যক্রম ভন্ডুল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সব ষড়যন্ত্রেই ভূমিকা রাখার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তবে, সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন রবিউল।
আরো গুরুতর অভিযোগ এনসিটিবির আরেকজন সদস্যের বিরুদ্ধে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সিন্ডিকেটের অন্যতম সক্রিয় সদস্য হিসেবে শিক্ষা ক্যাডারে ও মাদ্রাসাখাতে পরিচিত রিয়াদ চৌধুরী পাঁচ বছর বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রকাশনা নিয়ন্ত্রক পদে ছিলেন। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে চলে আসতে সক্ষম হন। শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি, নিয়োগ ও পদায়নে দীপু মনির সিন্ডিকেটের টাকার খেলার কথা সবার মুখে মুখে। মাদ্রাসার নোট-গাইডসহ যাবতীয় বইয়ের প্রকাশকদের কাছ থেকে প্রথম বছরেই বিনিয়োগের টাকা উসুল করে নেয়ার অভিযোগ প্রায় সবার মুখে মুখে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার শিক্ষা ক্যাডার স্ত্রী আওয়ামী লীগ পরিচয়ে বহু বছর ধরে এনসিটিবিতে আছেন। এনসিটিবির সচিব পদটি বাগানোর সব চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখন পাঠ্যবই নিয়ে অপপ্রচার সংঘের সদস্য হয়েছেন। পাঠ্যবইয়ে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নিয়ে উসকানি দিচ্ছেন। কয়েকটি প্রচারমাধ্যমে উসকানিমূলক লেখাও প্রকাশ করাতে পেরেছেন তিনি। এনসিটিবির যাবতীয় সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই বাইরে চলে যায় তার মাধ্যমে। এই সিন্ডিকেটে আছেন বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমানও।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রিয়াজুল হাসানের শেষ কর্মদিবস আগামী ২৬ জানুয়ারি। চেয়ারম্যান পদ পেতে মরিয়া এনসিটিবির আরেকজন সদস্য ইতিমধ্যে কয়েকটি বিতর্কিত কাণ্ড করেছেন। পাঠ্যবইয়ে সঠিক ইতিহাস সংযোজন ও পরিমার্জন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাখাল রাহাসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। শিক্ষা ক্যাডারে শত শত অভিজ্ঞ ইংরেজি শিক্ষক থাকতেও বইয়ের ইংরেজি ভার্সনের বিশেষজ্ঞ ও তথ্যজ্ঞ হিসেবে নাজিল করিয়েছেন কেজি স্কুলের কথিত এক অধ্যক্ষকে। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে কখনো কুয়াকাটায় কখনো রংপুরে কর্মশালা করে বেড়াচ্ছেন প্রাথমিক শাখার ওই সদস্য।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির একজন সিনিয়র সদস্য দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, পাঠ্যবই ছাপার কাজ যারা পেয়েছেন তাদের যদি দেশ ও জাতির প্রতি কমিটমেন্ট থাকে তাহলে বই নিয়ে অস্থির পরিবেশ তৈরি করবেন না। টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী কাগজে ও সময়মতো বই সরবরাহ করতে মুদ্রাকরদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও উচিত এনসিটিবিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার। দীপু মনি-নাজমা ও ফরহাদুল ইসলামের সিন্ডিকেট ভাঙ্গাটা খুবই জরুরি। নজরদারির দায়িত্বরতদের মধ্যেও রয়েছে আওয়ামী জমানার কর্মকর্তাদের প্রধান্য।
তিনি বলেন, পাঠ্যবই ছাপার আগে যেন নোট-গাইড বা সহায়ক বই না ছাপে-এমনি নির্দেশনার পরও ঢাকার বাইরের প্রেসগুলোতে ছাপা হচ্ছে। কিন্তু এনসিটিবির কতিপয় কর্মকর্তা মোটা টাকার পেয়ে ঢাকার বাইরে যাচেছন না। পাঠ্যবই ছাপার কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। অথচ নোট-গাইড ছাপা হচ্ছে দেদার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির সম্পাদনা শাখার একজন কর্মকর্তা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, নোট-গাইড ছাপাখানার মালিকদের হাতে পাঠ্যবইয়ের নতুন তথ্য ও মানবন্টন ও সিলেবাস অগ্রিম চলে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এবং এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টার নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য চেপে যাওয়ার তদবির করে রবিউল কবির চৌধুরী ও সম্রাট নামের একজন। শিক্ষা ক্যাডারে যোগদানের আগে কথিত সাংবাদিকতার তকমা লাগানো সম্রাটের সঙ্গে নোট-গাইড কোম্পানিগুলোর মালিকদের সখ্য দীর্ঘদিনের। উপদেষ্টার নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি সঠিকভাবে প্রতিবেদন দিতে পারছে না রবিউল ও সম্রাটের প্রভাবে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রবিউল ও সম্রাটের ভূমিকা শিক্ষা ক্যাডারে সবার জানা। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার সমিতির নেতা হিসেবে দুইজন ইতিমধ্যে ঢাকার বাইরে বদলি হলেও সম্রাট পেয়েছেন প্রাইজ পোসিটং। এর পেছনেও নোট-গাইড মালিকদের ভূমিকা রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আওয়ামী লীগ জমানার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে রেখে সঠিক ইতিহাস সংযোজন করে পাঠ্যবই দেওয়া সম্ভব হবে না। নোট-গাইড ও মুদ্রাকরদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেরি করলে আসছে জানুয়ারিতে পাঠ্যবই নিয়ে মহা কেলেংকারির মুখে পড়তে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। যেটা দেশের কোনো সচেতন মানুষই কামনা করেন না।