সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ করার সময় বিভিন্ন পর্যায়ে পরামর্শ গ্রহণ করা হলেও এখনো এতে কিছু অস্পষ্ট বিধান রয়েছে। পাশাপাশি বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করার মতো ধারা অধ্যাদেশটিকে নিবর্তনমূলক বানিয়েছে। এ ধরনের নিবর্তনমূলক বিধান জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে যায় না। তাই অধ্যাদেশ সংশোধন করে নিবর্তনমূলক ধারা বাদ ও বিধান স্পষ্ট করতে হবে।
শনিবার (৫ জুলাই) সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে এক সেমিনারে আলোচকদের কথায় এ অভিমত উঠে আসে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) 'সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ কতটুকু সুরক্ষা দেয়?' শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে নাগরিক ঐক্য।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আইনে অস্পষ্টতার সুযোগ থাকলে যারা আইন প্রয়োগ করে, তারা জনগণের ওপর নিপীড়ন চালায়। আইনে যদি অস্পষ্টতা থাকে এবং জনগণ হয়রানির শিকার হয়, তাহলে সে অস্পষ্টতা দূর করার কতব্য যারা আইন করেন, তাদের।
যা যা পরিবর্তন করা প্রয়োজন ছিল, তা এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে অর্জিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা। তিনি বলেন, এই অধ্যাদেশে অতীতে যারা শাস্তি পেয়েছেন, তারা মুক্তি পাবেন কিন্তু ঘুরেফিরে ওই একই বিধান আরেক জায়গায় রাখা হয়েছে। এতে করে একই অভিযোগে গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ রয়ে গেছে। এর চেয়ে বড় অযৌক্তিক আর কী হতে পারে। অধ্যাদেশের বিধানে অস্পষ্টতা আছে।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, আইন করা হয় মানুষের জন্য। কিন্তু মানুষ তা বোঝে কি না, সেই প্রশ্ন রয়ে যায়। রাজনীতিক, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতি অনুরোধ, এসব আইন মানুষকে জানান ও বোঝান, যেন মানুষ বুঝতে পারে ও আইনের ত্রুটি সম্পর্কে জানতে পারে।
আইনের অপব্যবহার ও ব্যত্যয় ঘটিয়ে জনগণের ওপর নিপীড়নকারীদেরও শাস্তি দেওয়া ও জবাবদিহির আওতায় আনার বিধান থাকা উচিত বলে মনে করেন এই বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড চলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে। কিন্তু সেখানে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও এই সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে আলোচনা নেই।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। অধ্যাদেশের ৩৫ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের বিধানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, যদিও সরকার বলছে বিধানটি আগের মতো উন্মুক্ত নয়, সংকুচিত করা হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো সীমাবদ্ধতায় থাকে না। তাই এই অধ্যাদেশ রাখা যাবে না।
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও মব ভায়োলেন্সের (দলবদ্ধ জনতার সহিংসতা) সমালোচনা করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি। তিনি বলেন, থানা ঘেরাও করে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তার প্রশ্ন, এই মব বন্ধ করতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে করবে, এই সরকার?
ভয়েস ফর রিফর্মের সহসমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর বলেন, সরকার এই অধ্যাদেশ করার আগে অনেক কিছুই আমলে নিয়েছে। এতে বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে অপরাধ করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এই বিধানের সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। আগে দেখা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থা ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মতো প্রতিষ্ঠান টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রবেশ করে মানুষের ফোনকনন ফাঁস করেছে। তারাই গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেছে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অর্থ সমন্বয়ক দিদারুল ভূঁইয়া বলেন, বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল কোনো কালাকানুন না রাখা। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে সরকারের চেষ্টা ছিল। কিন্তু সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কিছু করতে পারেনি তারা। এখনো বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের বিধান আছে। এ ধরনের নিবর্তনমূলক বিধান জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে যায় না। এই অধ্যাদেশ সংশোধন করতে হবে।
সেমিনারে মূল বক্তব্য পাঠ করেন নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার। আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রধান সমন্বয়ক আকরাম হুসাইন প্রমুখ।