ময়মনসিংহের বাতিঘর আনন্দ মোহন কলেজ | কলেজ নিউজ

ময়মনসিংহের বাতিঘর আনন্দ মোহন কলেজ

ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ আনন্দ মোহন কলেজে ‘মার্কেটিং’ ও ‘ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং’ বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করা হয়েছে।

#শিক্ষার্থী #শিক্ষক

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার যতগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে সেরাদের তালিকায় রয়েছে ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ। কলেজটিতে প্রবেশ করলে সবার আগে নজরে আসে তিনটি ম্যুরাল, যার একটি আনন্দমোহন বসুর। তার নামেই প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ। শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক আনন্দমোহন বসু ময়মনসিংহ শহরের রাম বাবু রোডে নিজ পৈতৃক ভিটায় ‘ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন’ নামের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি পরে নানা ঘটনা পরম্পরায় ‘ময়মনসিংহ সিটি কলেজ’ হয়ে ওঠে। এই কলেজ ছিল মূলত কলকাতা সিটি কলেজের শাখা। প্রাথমিক অবস্থায় কলকাতা সিটি কলেজ কাউন্সিলের আর্থিক সহযোগিতায় ময়মনসিংহ সিটি কলেজ পরিচালিত হতো। কিন্তু ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দমোহন বসুর মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠানটি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহ সিটি কলেজের প্রিন্সিপাল বৈকুণ্ঠকিশোর চক্রবর্তী ও ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাক উড কলেজটির পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। প্রাথমিকভাবে এই কমিটি ময়মনসিংহ সিটি কলেজের পরিচালনা ও যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নেয়। তখন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ময়মনসিংহ কলেজ’। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে কলেজটিকে বর্তমান স্থানে আনা হয়। তখনই নাম হয় ‘আনন্দ মোহন কলেজ’। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পুরোদমে চালু হয় কলেজের কার্যক্রম।

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়ালেখার জন্যও আনন্দ মোহন কলেজের বেশ সুনাম আছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় এই কলেজের শিক্ষার্থীদের সুযোগ পাওয়ার হার কম নয়।

বর্তমানে কলেজটিতে ৪টি অনুষদ ও ২০টি বিভাগ রয়েছে। কলা অনুষদের অধীনে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও ইসলাম শিক্ষা বিভাগ। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজকর্ম, সমাজবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও দর্শন বিভাগ। বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ। ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের অধীনে রয়েছে হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগ।

আনন্দ মোহন কলেজ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। এই কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৫০ হাজার বই নিয়ে একটি সমৃদ্ধ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, গবেষণাগার, কলেজ ক্যান্টিন, কেন্দ্রীয় মসজিদ, প্রতিটি বিভাগে অসংখ্য বইসহ সেমিনার, মেডিকেল সেন্টার, আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৭টি হল, যার মাঝে ছেলেদের জন্য বর্তমানে ৩টি (নির্মিতব্য ২টি) এবং মেয়েদের জন্য ৪টি আবাসিক হল। এ ছাড়া দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে কল্যাণ তহবিল এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন রোডে চলাচলের জন্য রয়েছে ৩টি শিক্ষার্থী বাস।

কলেজের একাডেমিক ভবনগুলোতে বিভিন্ন বিভাগের পাশাপাশি দেখা যাবে বিএনসিসি, রোভার স্কাউটসহ বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আন্তকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা ২০২৩-এ জাতীয় পর্যায়ে রানারআপ হয় আনন্দ মোহন কলেজের বিতার্কিক দল। টেলিভিশন বিতর্কেও কলেজটির সাফল্য ছিল নজরকাড়া। রক্তদাতা সংগঠন (বাঁধন), সাংস্কৃতিক পরিষদ, পরিবেশ ক্লাব, বোটানি ক্লাবের মতো নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও কলেজে বেশ সরব।

কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমান উল্লাহও বিষয়টির প্রতি আলাদা গুরুত্ব দিলেন, একাডেমিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রমকে যুগপৎভাবে এগিয়ে নিয়ে আমরা আমাদের কলেজকে দেশ সেরা কলেজ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি। তবে এককভাবে এই কাজ করা বেশ কঠিন। আমাদের সদিচ্ছার পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, যারা বর্তমানে ভালো অবস্থানে আছে, তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।

ময়মনসিংহের বাতিঘর আনন্দ মোহন কলেজ

কলেজে ‘মার্কেটিং’ ও ‘ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং’ বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমান উল্লাহ।

২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৯ আগস্ট আনন্দ মোহন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন হন অধ্যাপক মো. আমান উল্লাহ। তিনি একই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করে আসছিলেন।

জানা গেছে, ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাকতা ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মো. আমান উল্লাহ। তিনি ছাত্র জীবনে ফুলবাড়িয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসি ও আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫-৮৬ সেশনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে ১৪তম বিসিএসের মাধ্যমে তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে প্রবেশ করেন।

আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের পর আমান উল্লাহ নিম্নোক্ত কাজগুলো করেন-

>> করোনার লকডাউনশেষে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনা। কলেজ ক্যাম্পাস পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা করা এবং সৌন্দর্যবর্ধনে বাগান করা হয়।

>> বিভিন্ন হোস্টেল শিক্ষার্থীদের থাকার উপযোগী করা এবং বিভাগগুলো উন্নয়ন করা হয়।

>> শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রায় এক কোটি টাকা বরাদ্দ এনে লাল দালান রিপেয়ার করা ও রং করা হয়।

>> ১০ তলা একাডেমিক বিল্ডিংয়ের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নানা কারণে। সেটিকে নানা দপ্তর প্রধানদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে পুনরায় নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়, যা প্রায় শেষের পথে। তাতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুম সংকট কমে যাবে।

>> শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি হোস্টেল নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে যাতে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে। যাতে শিক্ষার্থীদের থাকার সংকট কমে যাবে।

>>শিক্ষকদের জন্য দুটি ডরমিটরি নির্মাণ হচ্ছে যাতে শিক্ষকরা ব্যাপক উপকৃত হবেন।

>>কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষক পরিষদের মিটিং রুম সংস্কার, ২০টি বিভাগের ২০টি ক্লাস রুম আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

>> শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, বিতর্ক, নবীনবরণ, সমাপনী অনুষ্ঠান, বসন্তবরণ, বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, সেমিনার ও অন্যান্য সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে করা হয় যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়। আনন্দ মোহন ক্যাম্পাসকে আনন্দময় ক্যাম্পাসে রুপান্তরিত করা হয়।

>> কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি নির্মাণাধীন থাকায় বিভাগীয় সেমিনার লাইব্রেরি সমৃদ্ধ করা হয়। হোস্টেলে পাঠকক্ষ তৈরি করে দেওয়া হয়।

>> এছাড়াও অডিটোরিয়াম ও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি নির্মাণ করার জন্য শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে দ্রুত কাজ করানো হচ্ছে।

>> পুকুরের চারপাশে গাইড ওয়াল নির্মাণ করে তাতে ওয়াকিং পাথ নির্মাণ কাজ পাইপ লাইনে রয়েছে। যাতে শিক্ষক/শিক্ষার্থীরা একটি নান্দনিক পরিবেশ পাবে।

>> ফ্লাগস্ট্যান্ড উন্নত ও দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে।

>> সিইডিপি প্রকল্পের আওতায় প্রায় আঠারো লাখ টাকা ব্যয়ে প্রতিটি বিভাগ ও পুরনো ক্যাম্সাস ইন্টারনেট সেবায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে হোস্টেলসহ পুরো ক্যাম্পাস ইন্টারনেট সুবিধায় আনা হবে।

>> বিএনসিসি ও রোভার স্কাউট ডেন এর উন্নয়ন ও তাদেরকে সুসজ্জিত করা হয়েছে। যাতে তারা মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ হয়। ইতোমধ্যে তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বন্যার্ত ও পীড়িত মানুষের সেবা করছে।

>> আনন্দ মোহন কলেজে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক কর্মকর্তাদের আরও ১১৬টি পদ সৃষ্টির চূড়ান্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। যা ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদন লাভ করেছে।

>> ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে একটি দৃষ্টিনন্দন ক্যান্টিন নির্মাণ করা হয়েছে।

অধ্যক্ষ আমান উল্লাহকে নিয়ে তার এক ছাত্র দীপ্ত আনোয়ার বলেন, আমানুল্লাহ স্যার আমার বিভাগের শিক্ষক। স্যারের কিছু বৈশিষ্ট্য সব সময় আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি সব সময় হাসি মুখে কথা বলেন। কখনো রাগান্বিত বা উত্তেজিত হতে দেখিনি। স্যার আমাদের সব সময় মহৎ কাজে উৎসাহিত করেন।

#শিক্ষার্থী #শিক্ষক