আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের ভূমিকা ও প্রতিবন্ধকতা আলোচনা চট্টগ্রামে | বিবিধ নিউজ

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের ভূমিকা ও প্রতিবন্ধকতা আলোচনা চট্টগ্রামে

আইনের শাসন হলো সেই নীতি যা নিশ্চিত করে যে রাষ্টের সকল কর্মকান্ড আইন দ্বারা পরিচালিত হবে এবং নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষিত হবে।

#বিচার বিভাগ #জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন এবং চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের ভূমিকা ও প্রতিবন্ধকতা শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

বুধবার (৭ মে) আইনজীবী সমিতির অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মোঃ নুরুল ইসলাম। সভায় ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৭ম আদালতের বিচারক এবং সহসভাপতি, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের ফেরদৌস আরা।

আইনের শাসন সঠিকভাবে প্রয়োগ ও নিশ্চিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন এবং চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের ভূমিকা ও প্রতিবন্ধকতা শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা বিভিন্ন দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য ও করণীয় সর্ম্পকে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুস সাত্তারের সভাপতিত্বে এবং সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ হাসান আলী চৌধুরী সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহানগর দায়রা জজ মোঃ হাসানুল ইসলাম, চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মিজানুর রহমান, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ফাইন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান এ.এস.এম. বদরুল আনোয়ার, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক সদস্য মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এস.এম. নছরুল কদির, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ এবং চট্টগ্রামের বিচারকবৃন্দ ও সিনিয়র আইনজীবীবৃন্দ।

সভায় বক্তারা বলেন, আইনের শাসন হলো সেই নীতি যা নিশ্চিত করে যে রাষ্টের সকল কর্মকান্ড আইন দ্বারা পরিচালিত হবে এবং নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষিত হবে। আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান। বিচারিক প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্টের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় দুই ধরনের আদালত রয়েছে। একটি জেলা আদালত বা নিম্ন আদালত এবং অপরটি সুপ্রিম কোর্ট বা উচ্চ আদালত। একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচার আদালতের কাজ হল নিরপেক্ষভাবে ও দ্রুততার সহিত মামলা র্আৎ বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষা প্রদান করা। আমাদের সুপ্রীম কোর্টে ও জেলা আদালতসমূহে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বিচারক সংখ্যার অপ্রতুলতা ও মামলা জচ ও নানাবিধ কারণে মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লাগছে। বর্তমানে আদালতে ৪২ লাখের অধিক মামলা বিচারাবীন রয়েছে। যা বিচারের জন্য রয়েছে মাত্র দুই হাজার বিচারক। মামলার সংখ্যার অনুপাতে বিচারকের পদ সৃজন করে মামলার জট কমিয়ে আনা একমাত্র সমাধান। অথচ বিচারকের পদ বৃদ্ধি বা বিচারকের পদ সৃজনের ক্ষমতা বিচার বিভাগের নেই। এ ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত। তাছাড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আদালতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। বর্তমানে অনেক আদালতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক বিচারককে এজলাস শেয়ার করে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হয়। যার ফলে বিচারিক কর্ম ঘন্টার সঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তবে বিচার বিভাগ চাইলেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন বা স্থাপন করতে পারে না। কারণ আদালতের অবকাঠামোগত উনয়ন ও স্থাপন গ্রহণের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত। অন্যদিকে বিগত বছর গুলোতে রাজনৈতিক মামলা নামে খ্যাত এক বিশেষ ধরনের মামলা আবির্ভূত হযেছে। মামলাসমূহ বিচারের ক্ষেত্রে অনেক আদালত নিরপেক্ষতা দেখাতে চরমভাবে ব্যর্থ হযেছে। এছাড়া সরকার বা সরকারে থাকা বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণকারী নির্বাহীর ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলাসমূহ নিষ্পত্তির ক্ষেত্র বিচার বিভাগ নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চরম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। যার প্রধান কারণ বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পরাধীনতা।

জেলা আদালতের বিচারকদের বদলি, নিয়োগ, পদায়ন ও শৃংঙ্খলা বিধান বহুলাংশে নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত। শাসক শ্রেণী এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলাসমূহ বিচারের ক্ষেত্রে অযাচিত প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়। একইভাবে আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেওবিচার বিভাগকে অযাচিত হস্তক্ষেপের মুখোমুখি হতে হয়।

বিচার বিভাগের সক্ষমতাকে পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করতে বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আইন মস্ত্রণালযের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয় মোট বাজেটের ০.৩ থেকে ০.৮ শতাংশ যা মৎস্য ও পশু সম্পদ মস্ত্রণালযের মোট বরাদ্দের চেয়েও কম।

সুপ্রীম কোর্ট বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এটি সংবিধানের অভিভাবক হিসাবেও কাজ করে। রাষ্ট্রের কোনো আইন বা সিদ্ধান্ত সংবিধান বিরোধী কিনা সে বিষযে ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষমতা শুধুমাত্র সুপ্রীম কোর্টের রয়েছে। তবে এই প্রতিষ্ঠানটি কখনো স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারেনি। বরং বিগত দশকে নানা সময়ে উচ্চ আদালতের ভ’মিকা নিয়ে জনমনে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। সরকার কিভাবে সুপ্রীম কোর্টকে ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক ফায়দা গ্রহণ করেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ আমাদেও সামনে রয়েছে। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা না থাকার সুযোগে সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাওয়াই সম্ভবত এইরুপ অবক্ষয়ের প্রধান কারণ। ফলে উচ্চ আদালত ও জেলা আদালতে নিরপেক্ষতার সাথে ও যৌক্তিক সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যর্থতার দায়ভার তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায়ভার প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক পরাধীনতার বেড়াজালে পিষ্ঠ বিচার বিভাগের উপর এককভাবে আরোপ না করাই সমীচীন। বিচার কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। বিচারকদের পদ সৃজন, বাজেট প্রাক্কালন, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাজেট বরাদ্দকরণসহ প্রাসঙ্গিক সকল ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পৃথক "বিচার বিভাগীয় সচিবালয়" গঠনের কোনো বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে সুপ্রীম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ ২০২৫ হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা অধ্যাদেশের বিধি বিধানের আলোকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ করা হবে।

এছাড়া বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ন্যায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রস্তুতক্রমে আইন মস্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা সেটি দ্রুততার সাথে বাস্তবায়ন হবে। জুলাই গণ অভ্যুথানের পর রাষ্ট্রের নানা বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান সংস্কারের জন্য সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি তাঁর এক বক্তব্যে বলেছেন বিচার বিভাগের সংস্কার না হলে অন্য সকল সংস্কার অর্থহীন হয়ে পড়বে। আমরা প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে এমন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ দেখতে চাই যা রাষ্টের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করবে এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করবে।

#বিচার বিভাগ #জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন