ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) তিনটি ছাত্রাবাসে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন শিক্ষার্থীরা। এসব ছাত্রাবাস প্রায় ৮০ ও ৫০ বছরের পুরনো। এর মধ্যে ছেলেদের দুটি ছাত্রাবাসের ১৫-২০ শতাংশ কক্ষ থাকার অনুপযোগী। এর মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ৭৫ বছরের পুরনো ‘শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হল’। এই হলের মূল ভবনের ২৫ শতাংশ কক্ষই থাকার অনুপযোগী। এর মধ্যে সাত মাস আগে গণপূর্ত বিভাগ মাত্র ১৩ শতাংশ কক্ষকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে।
এ ছাড়া কলেজের অ্যাকাডেমিক ভবনের অবস্থাও ভালো নয়। সেখানকার বিভিন্ন বিভাগের ভবনের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভবনগুলো জীর্ণদশায় রূপ নিয়েছে।
কলেজের কে-৭৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, বছরের পর বছর এখানকার ছাত্রছাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব জরাজীর্ণ কক্ষে থাকছেন। হলের বিভিন্ন কক্ষের ছাদ থেকে প্লাস্টার খসে পড়ে। একটা ভূমিকম্প হলেই গোটা হল ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্যই আমরা নতুন হল নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি এবং দ্রুত সংস্কার শুরু করতে বলছি।
হলের এমন জীর্ণদশার কারণে নতুন হল নির্মাণ ও ছাত্রছাত্রীদের বিকল্প আবাসনের দাবিতে এক মাস ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করছেন। তাদের আন্দোলনের মুখে গত শনিবার অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেন কলেজ কর্র্তৃপক্ষ এবং গতকাল দুপুর ১২টার মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করেননি। তারা আজ দুপুর ১২টার মধ্যে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের হলের ভগ্নদশা পরিদর্শন করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল আলম বলেন, তাদের দাবির সঙ্গে একমত। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এ জিনিসটা একবারেই হয়নি। বিগত ১৫ বছর ধরে হাসপাতালকে পাঁচ হাজার বেডে উন্নীত করে একটা মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে সেটি একনেকে পাস হয়নি। এই মেগা প্রকল্পের কারণে অন্য কোনো বড় সংস্কারও ঢাকা মেডিক্যালে হয়নি। যে কারণে কলেজের অ্যাকাডেমিক ভবন ও ছাত্রদের হোস্টেলের এ দুর্দশা। এর ভেতরে ফজলে রাব্বি হলের মেইন বিল্ডিংয়ের চারতলায় অবস্থা খুবই খারাপ এবং সেই চারতলা পিডব্লিউডি কর্তৃক পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্রদের জীবনের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে ৯ মাস ধরে এ পরিত্যক্ত ভবন থেকে তাদের সরানোর চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু তাদের সরানো যায়নি।
কলেজ অধ্যক্ষ আরও বলেন, ডা. ফজলে রাব্বি হলের বাকি যে তিনটি ব্লক আছে, সেগুলো এখনো পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়নি। সেখানে আমাদের ছাত্ররা থাকে। কিন্তু সিনিয়র ছাত্রদের কেউ এক রুমে দুজন থাকতে চায়, কেউ এক রুমে তিনজন থাকতে চায়। কিন্তু সবাই যদি কক্ষের সিট অনুযায়ী থাকতে সম্মত হতো, তাহলে নতুন ব্যাচসহ ৭৫৫ জন ছাত্রের সবাইকে সিট দেওয়া যেত। তাদের চারতলা ও গণরুমে থাকতে হতো না।
শিক্ষক ও ছাত্ররা জানিয়েছেন, শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলের মূল ভবনের ২৫ শতাংশ কক্ষ জীর্ণ ও থাকার অনুপযোগী হলেও গণপূর্ত বিভাগ পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে মাত্র ১৩ শতাংশ কক্ষ।
কলেজের তথ্য অনুযায়ী, কলেজে নতুন ব্যাচসহ মোট ছাত্র ৭৫৫ জন। তাদের মধ্যে হলে থাকেন ৬২৫ জন। হলের মূল ভবনের চারতলার ৩৬টি কক্ষ গণপূর্ত বিভাগ পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। এসব কক্ষে ১৭২ জন ছাত্র থাকতেন।
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ডা. ফজলে রাব্বি হলের মূল ভবনের ২৫ শতাংশ কক্ষ জীর্ণ পরিত্যক্ত। থাকার অনুপযোগী। আর গোটা হলের ১৫-২০ শতাংশ কক্ষ থাকার অনুপযোগী ও জীর্ণ। অথচ সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে মাত্র একটি ভবনের ১৩ শতাংশ কক্ষ। ফলে ছাত্রদের ঝুঁকি নিয়েই থাকতে হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, ছাত্রদের ডা. ফজলে রাব্বি হলের চারটি ভবন মেইন বিল্ডিং ও তিনটি ব্লক এবং ইন্টার্নি হলের একটি ভবন। প্রত্যেকটি ভবন চারতলাবিশিষ্ট। এসব হলে মোট কক্ষ আছে ২৮৯টি। তার মধ্যে মেইন ভবনে ১২০টি কক্ষ ও সেখানে চারজন করে ৪৮০ জন ছাত্র থাকতে পারেন। তিনটি ব্লকে কক্ষ আছে ৮৭টি। এখানে প্রত্যেক কক্ষে দুজন করে ১৭৪ জন থাকতে পারেন। এ ছাড়া ইন্টার্নি হলে কক্ষ আছে ৮২টি।
ঢামেক ছাত্ররা জানিয়েছেন, পিডব্লিউডি ডা. ফজলে রাব্বি হলের মেইন ভবনের চারতলাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। সেখানে ৩০টির মতো রুম। ওই রুমগুলো বড়, ওখানে ১৭২ জন থাকতেন। সাত মাস আগে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এ চারতলা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই মূল ভবনের পিলারের অবস্থা খুব খারাপ। বিল্ডিংয়ের স্থায়িত্ব আর বেশিদিন মনে হয় টিকবে না। একটা ভূমিকম্প হলে বড়সড় একটা ঝুঁকি তৈরি হবে। এ ছাড়া দোতলার ওয়াশরুমের পলেস্তারা খসে পড়েছে। ছাদের একটা বড় অংশ খসে পড়েছে। এরকম খসে পড়ছে অনেক জায়গা থেকেই।
কে-৭৯ ব্যাচের ছাত্র আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, এ ভবনগুলোর বয়স ৮০ বছরের বেশি। ফজলে রাব্বি হলের পুরোটাই পরিত্যক্ত ঘোষণা করার সময় হয়েছে। পুরনো অ্যাকাডেমিক ভবনের অ্যানাটমি মিউজিয়ামের ছাদের একটা বড় অংশ খসে পড়েছে। পুরনো অ্যাকাডেমিক ভবনের পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, হোস্টেলে আটশর বেশি শিক্ষার্থী থাকেন। নতুন ব্যাচের জন্য গণরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটার প্রতিবাদ করি। যেহেতু সিট দিতে পারছে না তাহলে তাদের জন্য বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা করুক। কলেজ কর্র্তৃপক্ষ তো বলতে পারবে না কে হলে থাকবে আর কে হলে থাকবে না। অনেকে বাসা নিয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে হলে আসে, মাঝেমধ্যে বাসায় থাকে। পরীক্ষার সময় হলে থাকে। ওয়ার্ডে ডিউটি করতে হলে থাকতে হয় হলে; সেজন্য তারা বেড রাখে। মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা এমন, আপনি আলাদা করতে পারবেন না কে হলে থাকবে আর কে থাকবে না। এ কারণে সবাইকে সিট দিতে হয়।
ঢামেক ছাত্রছাত্রীদের যে তিনটি হোস্টেল রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ছাত্রীদের হোস্টেল। কলেজের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, কলেজে ছেলেদের হোস্টেল দুটি। এর মধ্যে শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হল নির্মিত হয় ১৯৫০-৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। সে হিসাবে এ হোস্টেলের বয়স ৭৫ বছর। অন্যটি ইন্টার্নি চিকিৎসকদের জন্য ‘শহীদ ডা. মিলন ইন্টার্নি হোস্টেল’ নির্মিত হয় ১৯৭৪-৭৫ খ্রিষ্টাব্দে। সে হিসাবে এই হোস্টেলের বয়স ৫০ বছর। অন্যদিকে, ছাত্রীদের ডা. আলীম চৌধুরী হল নির্মিত হয় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে। সে হিসাবে এই হল সবচেয়ে পুরনো ও বয়স ৭৮ বছরের মতো।
পাঁচ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত হল ছাড়বে না বলে সাফ জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ আজ দুপুর ১২টার মধ্যে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা হল পরিদর্শনে না এলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তারা।
গতকাল রবিবার দুপুর ২টার দিকে দাবির বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষার্থীরা অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সঙ্গে বৈঠক শেষে এমন হুঁশিয়ারি দেন। এ সময় শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমাদের দাবির বিষয়ে কর্র্তৃপক্ষের কাজের কোনো অগ্রগতি দেখিনি। হল ত্যাগের যে নোটিশ ছিল, আমরা সেটি প্রত্যাখ্যান করেছি এবং সেটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। আমরা হল ত্যাগ করছি না।
সব ছাত্রকে ঝুঁকিমুক্ত সিট বরাদ্দ দিতে হলে ছাত্রদের হল ত্যাগ করতে হবে বলে জানিয়েছেন ঢামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কামরুল আলম। গতকাল নিজ কার্যালয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের দুটো কনসার্ন; একটা ছাত্রদের নিরাপত্তা, আরেকটা দ্রুত অ্যাকাডেমিক কাজে ফিরে আসা। সেজন্য একাডেমি কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপাতত কলেজ বন্ধ থাকবে। তাদের হল ত্যাগ করতে হবে এবং ওই চারতলা থেকে (গতকাল) সবাইকে নামতে হবে এবং হলে শিক্ষকরা যেভাবে সিট বণ্টন করবেন, সেই অনুযায়ী ছাত্ররা যদি ওঠে তাহলে আমরা অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে পারব। আমরা প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করছি। মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগের মেগা প্রকল্প আর হবে না। ১৯টা মেডিক্যালে ১৯টা হোস্টেলের কাজ হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ১৭টির কাজ শুরু হয়ে গেছে। দুটো মেডিক্যালে হোস্টেল হওয়ার কথা ছিল, সেই মেডিক্যালে কলেজে লাগবে না। সেই দুটো মেডিক্যাল হোস্টেল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সেটা একনেকের ব্যাপার, পরবর্তী একনেকে এটা পাস হবে বলে আশা করছি।
এ বিষয়গুলো ছাত্রদের জানানো হয়েছে। আমি আশাবাদী তারা বাসায় ফিরে যাবে, আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে এবং পরে সুযোগ হলে আমরা একসঙ্গে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে কথা বলব, বলেন তিনি।