এমপিওভুক্তির জন্য সম্প্রতি আমতলী ও তালতলী উপজেলার ১১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার তালিকা বরগুনা জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে, আমতলীর ৭৬টি ও তালতলীর ৪৩টি ইবতেদায়ি মাদরাসা। অভিযোগ উঠেছে, অর্থের বিনিময়ে দালাল চক্রের যোগসাজশে এসব নাম-সর্বস্ব মাদরাসার তালিকা তৈরি করেছেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার অলি আহাদ।
এছাড়াও এই তালিকায় দুই উপজেলায় অনুদানভুক্ত স্বতন্ত্র ছয়টি মাদ্রাসাও আছে। তবে তালিকায় থাকা অধিকাংশ মাদরাসাকেই ‘ভূতুড়ে’ বলে অভিহিত করেছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, বাস্তবে এসব মাদরাসার অধিকাংশরই কোনো অস্তিত্ব নেই।
মাদরাসা শিক্ষকদের অভিযোগ, চাকরি এমপিওভুক্তির লোভ দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা তুলছেন আমতলী উপজেলা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আলাউদ্দিন ও জালাল পিয়াদাসহ ১০ জনের দালালচক্র। সেই পরিপেক্ষিতে, আমতলী ও তালতলীতে মাদরাসাপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে কিছু কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নাম পাঠানো হয়েছে এমপিওভুক্তির তালিকায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক বলেন, ‘প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা করে ধরছেন তারা। ইতোমধ্যে শিক্ষকের একটা অংশ দালালদের টাকাও দিয়েছেন।’
স্থানীয়রা বলছেন, ছয়টি অনুদানভুক্ত মাদরাসায় কোনো শিক্ষার্থী নেই। তবে শিক্ষকরা কাগজে-কলমে এসব মাদরাসায় কিছু শিক্ষার্থী দেখিয়ে আসছেন। সেই মাদ্রাসাগুলো হলো- পুর্ব চিলা হাসানিয়া, মধ্য পাতাকাটা আমানদিয়া, উত্তর ঘোপখালী, মোহাম্মদপুর (নাচনাপাড়া) মাহমুদিয়া, কুতুবপুর ইসরাইলিয়া ও তালতলীর চামোপাড়া মজিদিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে এসব মাদরাসার নামে কাগজে কলমে শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে। আমতলীর ৭৬টি মাদ্রাসায় ৯ হাজার ৭৫০ জন শিক্ষার্থী এবং তালতলীর ৪৩টি মাদ্রাসায় পাঁচ হাজার ৯৫০ জন শিক্ষার্থী আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে দুয়েকটি ছাড়া কোনো মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী নেই।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ জানুয়ারি অর্ন্তবর্তী সরকার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়। এরপরই সক্রিয় হয় আমতলী-তালতলীর একাধিক দালাল চক্র।
সম্প্রতি আমতলী উপজেলার অনুদানভুক্ত মাদরাসা কুতুবপুর ইসরালিয়া, মধ্য পাতাকাটা আমানদিয়া, মোহাম্মদপুর মাহমুদিয়া ও তালতলী উপজেলার একমাত্র চামোপাড়া মজিদিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা ঘুরে দেখা গেছে, মাদরাসার ঘর আছে; কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী নেই।
এ ব্যাপারে কুতুবপুর ইসরাইলিয়া স্বতন্ত্র মাদ্রাসার ইবতেদায়ি প্রধান গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘এখনো বই পাইনি। তাই ক্লাস করতে পারছি না।’
অনুদানবিহীন তালিকায় থাকা গোজখালী তাছাউফ স্বতন্ত্র মাদ্রাসার কোনো ভবনই নেই। স্থানীয়রা জানান, ভবন তো নেই, শিক্ষার্থীও নেই। কিন্তু কীভাবে তালিকায় নাম গেছে, তা বোধগম্য নয়।
চরখালী স্বতন্ত্র মাদরাসায় ভবন আছে। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী নেই। স্থানীয়রা জানান, পাঁচ বছর আগে খালের পাড়ে মাদরাসা ঘর নির্মাণ করেছেন রাজ্জাক মৃধা। কিন্তু কোনোদিন কোনো শিক্ষার্থী আসেনি। এখন শুনছি, আবার চালু হবে।
চুনাখালী স্বতন্ত্র মাদরাসার কোনো অস্তিত্বই নেই। স্থানীয়রা জানান, ইঞ্জিনিয়ার ইলিয়াস মিয়া এই মাদরাসা করেছেন। কিন্তু ভবন ও শিক্ষার্থী কিছুই নেই।
পশ্চিম কেওয়াবুনিয়া মুজাহিদিয়া, উত্তর কাউনিয়া, কাউনিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসারও কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তালতলীর পূর্ব গাবতলী এইউ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নামে বাস্তবে কোনোকিছুরই অস্তিত্ব নেই। জাতীয়করণ ঘোষণার পরে মাদরাসার নাম তালিকায় দেওয়া হয়েছে।
তবে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আমতলী উপজেলা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মাদরাসার তালিকা চেয়েছেন, তাই তালিকা দিয়েছি।’ কিন্তু শিক্ষার্থী নেই এমন মাদরাসার নাম দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
দালালির অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে জালাল পিয়াদার ফোনে যোগাযোগ করা হলেও, তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অভিযোগের বিষয়ে আমতলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অনেক মাদরাসার অস্তিত্ব নেই। তারপরও বিভিন্ন চাপে পড়ে তালিকা করতে হচ্ছে।’
এদিকে দালালের মাধ্যমে টাকা নিয়ে তালিকা প্রস্তুতের কথা অস্বীকার করেছেন আমতলী উপজেলা শিক্ষা অফিসার অলি আহাদ। তিনি বলেছেন, ‘মাদরাসা অধিদপ্তর থেকে পাওয়া চিঠির নির্দেশনা মতেই তালিকা করা হয়েছে।’
এ ব্যাপারে বরগুনা জেলা শিক্ষা অফিসার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কাছে মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা চাওয়া হয়েছিলো, তাই তালিকা পাঠানো হয়েছে।’
এই বিষয়ে কথা হয় তালতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার উম্মে সালমা ও আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আশরাফুল আলমের সঙ্গে। তারা উভয়েই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা এবং অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।