দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশে জিডিপির সবচেয়ে কম শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত ২২ বছরের পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ছয় ভাগ বরাদ্দ রাখা উচিত। তবে দেশে বছরের পর বছর এ বরাদ্দ জিডিপির দুই শতাংশের আশপাশেই সীমাবদ্ধ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ১৮৯টি সদস্যদেশের মধ্যে যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ২০ ভাগ এবং মোট জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। তবে কোনো সরকারই তা আমলে নেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে বরং কমিয়েছে। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে আগামী এডিপিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমেছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
গত কয়েক বছর ধরেই বাজেটে অন্যান্য খাতের তুলনায় শিক্ষায় গুরুত্ব কমে আসছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার শিক্ষা খাতে জিডিপির সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছিল। এরপর থেকে গত ৯ বছরে এই বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা মোট জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ বা মোট জিডিপির এক দশমিক ৬৯ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আগামী অর্থবছরে আরো কমছে বলে জানা গেছে।
বাজেটের এ ভয়াবহ চিত্র একটি জাতিকে গলা টিপে হত্যা করার শামিল হিসেবে আখ্যায়িত করেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষা খাতকে ‘মেগা প্রকল্প’ হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপরে গুরুত্বারোপ করে শিক্ষাবিদরা বলেন, শিক্ষা খাত যে কোনো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি বিপন্ন হলে দেশের আর কোনো ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত বিকাশ সম্ভব নয়। শিক্ষা এমন একটি বিষয়, যা অন্য সব খাতকে স্পর্শ করে এবং সব অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।আগামী ২ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাতীয় বাজেট পেশ করবেন। ১৮ মে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। প্রায় সব খাতেই বরাদ্দ কমেছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে গত ১৮ মে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আগামী অর্থবছরের জন্য এ উন্নয়ন বাজেট অনুমোদন হয়। এতে তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে শিক্ষায়। এ খাতে ৯১টি প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা (১২ দশমিক ৪২ শতাংশ), যা চলতি এডিপির বরাদ্দ থেকে ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। শতকরা হারে এডিপির বরাদ্দ কমেছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ।
উন্নয়ন বাজেটকে দুষ্টুচক্র থেকে বের করে আনার চেষ্টার কথা উল্লেখ করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এবার চলমান প্রকল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। নতুন প্রকল্প কিংবা মেগা প্রকল্প নিচ্ছি না। বাড়তি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছি। প্রকল্পের দুর্নীতি, অসংগতি দূর করতে পরিবীক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির আকার ছিল ২ লাখ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা এডিপির আকার কমানোর পক্ষে। তারা বলেন, বিগত সরকারের আমলে বড় বাজেট তৈরি করা হতো। কিন্তু বাস্তবায়নের হার হতো কম। যেমন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৮১ শতাংশের মতো।শিক্ষাকে বলা হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুসারে প্রতি এক বছরে শিক্ষার বিপরীতে একজন ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি পায় ৯ শতাংশ। এ কারণে উন্নত দেশগুলোও ইউনেসকোর পরামর্শ অনুযায়ী দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি শিক্ষা খাতে ব্যয় বা বিনিয়োগ করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে উপরের দিকে রয়েছে মার্শাল আইল্যান্ডস (১৫ দশমিক ৮ শতাংশ) ও কিউবা (১২ দশমিক ৯ শতাংশ)। প্রতিবেশী দেশ ভারত শিক্ষা খাতে ব্যয় করে জিডিপির ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে এশিয়ার দেশগুলো মধ্যে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের দেশ সৌদি আরব। তাদের ব্যয় জিডিপির ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। ৭ শতাংশ ব্যয় নিয়ে ভুটান রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে।
এছাড়া চীন, পাকিস্তান, জাপানের এ খাতে ব্যয় যথাক্রমে ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। আফগানিস্তান বরাদ্দ দেয় ৪ দশমিক ১ শতাংশ।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ ও জিডিপির কমপক্ষে ৩ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান। একই সঙ্গে ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা ও রোড ম্যাপ প্রণয়নের পরামর্শও দিয়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রাক-বাজেট প্রেস কনফারেন্সে এসব প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য এক জন করে শিক্ষক থাকতে হবে। দেশে বর্তমান শিক্ষা ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত সরকারি কলেজগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা স্তরে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে।অথচ বর্তমান সরকারি কলেজসহ শিক্ষা প্রশাসনে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ১৬ হাজার। অর্থাৎ দেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৩১২। স্নাতক পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোতে গড়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষক পদ শূন্য।
অন্যদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক শিক্ষকের পর শূন্য। দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪৪ হাজার সহকারী শিক্ষক পদ শূন্য। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষর বেতনের পরিমাণের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন।