স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী মো. রাশেদুল আলম ও তার কলেজ শিক্ষক স্ত্রী অপর্ণা রানী দাসের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে এই দম্পতির বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদকের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ঢাকার অভিজাত প্লট ও ফ্ল্যাট, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসহ ২২ কোটি ৮০ লাখ ৫৭ হাজার ৭০৭ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান শেষে এই দম্পতির বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছেন দুদকের সহকারী কমিশনার মো. সাজিদ-উর-রোমান।
সূত্রটি জানায়, ২০১৮ থেকে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এলজিইডির জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী রাশেদুল। গত বছরের মে মাসে ছুটি নিয়ে বিদেশে পড়তে গেছেন। এখন পরিবার নিয়ে নিউজিল্যান্ডে আছেন তিনি।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশেদুলের নামে তিনটি ব্যাংক হিসাব ও তিনটি এফডিআর হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে সোনালী ব্যাংকের হিসাবে তার বেতনের টাকা জমা হয়। বাকি ব্যাংক হিসাবগুলোতে তিনি ঘুষের টাকা লেনদেন করেছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশেদুলের নামে শেলটেক ব্রোকারেজ লিমিটেড একটি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব রয়েছে। এই বিও হিসাবের মাধ্যমে রাশেদুলের নামে থাকা একটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাব থেকে ২০১৮ থেকে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানির ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬১ হাজার টাকার শেয়ার কেনা হয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অনুসন্ধানকালে রাশেদুল ও অপর্ণার নামে ব্যাংক হিসাবে থাকা সব টাকা অবরুদ্ধ এবং আবাসিক এলাকার প্লট ও রাশেদুলের নিজ এলাকা কুমিল্লার হোমনায় থাকা একটি জমি জব্দ করা হয়েছে।
রাশেদুল ও তার কলেজশিক্ষক স্ত্রীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিলাসী জীবন কাটানো রাশেদুলের সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল কিশোরগঞ্জ এলজিইডি। তিনি দেড় লাখ টাকার ঘড়ি পরতেন। নিয়মিত পাঁচ তারকা হোটেলে যেতেন খাবার খেতে। অনুসন্ধানে এসব হোটেলে লাখ লাখ টাকা বিল দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকার অভিজাত একটি বিপণিবিতান থেকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে চারটি দামি ঘড়ি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদকের অনুসন্ধানে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২৩-২৪ করবর্ষ পর্যন্ত রাশেদুল বেতন পেয়েছেন ৩২ লাখ ৩৫ হাজার ৬১৯ টাকা। তিনি সঞ্চয় দেখিয়েছেন ৮ লাখ টাকা।
এ ছাড়া করমুক্ত আয় ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৬১ টাকা, মায়ের কাছ থেকে উপহার ৪ লাখ টাকা, বাবা ও দাদির কাছ থেকে ৬ লাখ টাকার জমি পেয়েছেন, নিকটাত্মীয়র কাছ থেকে উপহার পেয়েছেন সাড়ে ৪ লাখ টাকার।
পাশাপাশি জিপিএফ (সরকারি কর্মচারীদের সাধারণ ভবিষ্য তহবিল) সুদ ও অন্যান্য আয় ৩ লাখ ২৭ হাজার ১৩৮ টাকা এবং রেমিট্যান্স থেকে ৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছেন রাশেদুল।
কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজের শিক্ষক রাশেদুলের স্ত্রী অপর্ণা রানী দাস। তার নামেও ৯১ লাখ ৯১ হাজার ৮৪২ টাকার সম্পদ রয়েছে।
এর মধ্যে একটি বেসরকারি ব্যাংকে (কিশোরগঞ্জ শাখা) রয়েছে ৬০ লাখ ৪৩ হাজার ৯০৮ টাকা। নগদ রয়েছে ৩১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া তার ১০ ভরি স্বর্ণালংকার রয়েছে।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, অপর্ণা ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিসিএসে (শিক্ষা ক্যাডার) উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে যোগ দেন। চাকরিজীবনের শুরু থেকে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত ১০ লাখ ৭৫ হাজার ২৫৬ টাকা সঞ্চয় করেছেন তিনি।
বেতন-ভাতা পেয়েছেন ১৬ লাখ ১০ হাজার ৮১০ টাকা। আয়কর নথিতে করমুক্ত আয় হিসাবে দেখিয়েছেন ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৮৬৮ টাকা।
অনুসন্ধানে দুদক অপর্ণার বৈধ আয় পেয়েছেন ৩৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৩৪ টাকা। এর বাইরে তার নামে থাকা সব সম্পদই অবৈধ।
এ বিষয়ে জানতে এলজিইডির জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী মো. রাশেদুল আলমের সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া দেননি। পরে মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠিয়েও জবাব পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাশেদুল যে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন, সেটা বৈধভাবে সম্ভব নয়।
তিনি দুর্নীতির মাধ্যমেই এই বিপুল সম্পদ করেছেন।