এআই কনটেন্টে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ানোর শঙ্কা | বিবিধ নিউজ

এআই কনটেন্টে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ানোর শঙ্কা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে আধুনিক এআই মডেলের সক্ষমতায় নতুন এক মাত্রা যোগ হয়েছে।

#এআই

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে আধুনিক এআই মডেলের সক্ষমতায় নতুন এক মাত্রা যোগ হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও এখন ব্যবহার হচ্ছে এআই দিয়ে তৈরি কনটেন্ট। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তৈরি হচ্ছে ভিডিও। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে এ ধরনের ভিডিওর মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা আরও বাড়তে পারে।

এ ক্ষেত্রে অনেক 'ফেক তথ্য' সংবলিত কনটেন্টও তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এআই দিয়ে তৈরি কনটেন্ট এক ধরনের নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।

বিশেষ করে, বিরোধী রাজনৈতিক দল বা প্রতিপক্ষের প্রার্থীরা এআই ব্যবহার করে পরস্পরের চরিত্র হনন বা সুনামহানি ঘটাতে পারেন বলে এরই মধ্যে আলোচনা উঠছে। বলা হচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন এবং দেশের অগ্রসর জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে এআই সম্পর্কে ধারণা থাকলেও অধিকাংশ মানুষের তা নেই। তা সত্ত্বেও ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ এসব কনটেন্ট দেখছেন এবং শেয়ার করছেন। কেউ কেউ ফেক বুঝতে পারলেও অনেকেই সেগুলো বাস্তব বলে বিশ্বাস করছেন। এভাবেই সমাজে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতে পালিয়ে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ফেস ব্যবহার করে এআই দিয়ে তৈরি এ ধরনের অজস্র কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কেউই রেহাই পাচ্ছেন না এসব ফেক কনটেন্ট থেকে। যদিও অনেকেই বুঝতে পারছেন যে, শুধু মজা বা ফান করার জন্য এসব তৈরি হচ্ছে। তবে নির্বাচনের সময় গ্রামে-গঞ্জে এসব কনটেন্ট কী প্রভাব ফেলবে তা ভেবে চিন্তিত হচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেন, সামনে নির্বাচন আসছে। টার্গেট করে কনটেন্ট তৈরির বিষয়টি আরও বাড়বে। এখানে উদ্বেগের বিষয় হলো, ভিডিও তৈরি এবং অডিও জেনারেট করা দিন দিন বেটার (ভালো) হচ্ছে। এতটাই রিয়েলিস্টিক বা বাস্তবসম্মত হচ্ছে যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে এটি আসল না নকল তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মতো দেশগুলোতে এটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা লোকের সংখ্যা কম। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতামূলক প্রচার অনেক কম।

গণমাধ্যমে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেভাবে প্রচার করা হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যদি বিষয়গুলো আসে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেটি বিশ্বাস করা যাবে না। সোর্স যাচাই করতে হবে। সোর্সগুলোর উদ্দেশ্য কী, সেটাও অনেক শিক্ষিত মানুষ জানে না। তথ্যসচেতনতা এবং মিডিয়া লিটারেসি নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। এগুলোর ইমপ্যাক্ট এত বেশি, জানমালের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কোনো বিকল্প নেই। সেদিকেই যেতে হবে। ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে।'

গত ৯ জুন সিপিবি ঢাকা দক্ষিণের ফেসবুকে একটি এআই জেনারেটেড ক্যাম্পেইন কনটেন্ট প্রকাশ করা হয়। যেখানে বলা হয় 'করিডর দেব না, বন্দর দেব না; মা, মাটি মোহনা, বিদেশিদের দেব না। যতক্ষণ পর্যন্ত বিদেশিদের বন্দর দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হবে, ততক্ষণ আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।'

২৪ সেকেন্ডের এই ভিডিওটি দেখেছে ২ লাখের বেশি মানুষ। ভিডিওর ক্যাপশনে এআই লেখা হলেও যখন বিভিন্ন পেজে সেটি শেয়ার করা হয়, তখন সেটি অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখ ছিল না। প্রথম দেখায় মনে হবে, হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। এটা বাস্তব ভিডিও। আবদুল্লাহ আল নোমান নামে একজন মন্তব্য করেছেন, বাস্তবে এমন কিছুর দরকার ছিল। অনেক এটিকে সময়োপযোগী প্রচার উল্লেখ করে প্রশংসা করেছেন। অনেক নেতিবাচক মন্তব্যও সেখানে ছিল।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শত শত পেজে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে এআই দিয়ে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে। পলিটিক্যাল মিমস তৈরি হচ্ছে অহরহ। এসব কনটেন্টে বিএনপি ও জামায়াতের অনুসারীরা পাল্টাপাল্টি যুক্তি এবং ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন। আসন্ন নির্বাচনে ভোট চেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে টার্গেট করে নেগেটিভ তথ্য দিয়ে ভিডিও নির্মাণ করা হচ্ছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দুটি ছাত্র সংগঠনের (ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির) নেতা-কর্মীরা ফেসবুকে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। যেখানে বট আইডিও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হয়েছে। আবার অনেক সময় নারীনেত্রীদের টার্গেট করেও এআই দিয়ে মিথ্যা অশালীন ভিডিও তৈরি করতেও দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের সাবেক পরিচালক ড. আসিফ হোসেন খান মনে করেন, এআই একটি টেকনোলজি, যা বহু ভালো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

তিনি বলেন, অ্যানিমেটেড ক্যারেক্টার দিয়ে কনটেন্ট বা ভিডিও বানানো একটা টেকনোলজি। যেটা বিশ্বের সবখানে আছে। এখন এই টেকনোলজিকে কে কীভাবে ব্যবহার করবে সেটায় দেখার বিষয়। আগে আমরা একটা ভিডিও দেখলে বিশ্বাস করতাম বা অডিও শুনলে বিশ্বাস করতাম। এখন সেটা নেই। এখন ধরে নিতে হবে এটাকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই।'

ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, ভিডিও দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নেব কি না, ভাবতে হবে। নাকি ধরে নেব ভিডিও যেকোনো সময় আনঅথেনটিক হতে পারে। প্রযুক্তি সব সময় ভালো জিনিস দেয়। কে কীভাবে ব্যবহার করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। যখন মোবাইল ফোন ছিল না, তখন কত সমস্যা। এখন মোবাইল ফোনে অনেক সুবিধা। আবার এটাকে ব্যবহার করে প্র্যাংক কল দেওয়া, হ্যাকসহ বিভিন্ন অপরাধ করা হচ্ছে। তাই বলে মোবাইল ফোন খারাপ হয়ে যায়নি।

অন্যদিকে, এআই নিয়ে রাজনীতিবিদদের সুস্পষ্ট ধারণা রাখার পাশাপাশি সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে মনে করেন অনেকে। কারণ রাজনীতি এখন মিছিল-মিটিং এ সীমাবদ্ধ নেই। এখন তথ্য নিয়ে নানা কৌশলে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এআই দিয়ে বানানো কনটেন্টে নিমিষেই রাজনৈতিক ইমেজ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় এআই তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক তথ্য বিশ্লেষণ, সাম্প্রতিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত যাচাই, জনমত তৈরিতে এআইয়ের ব্যবহার আরও বাড়বে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে নির্বাচনি পরিবেশ প্রভাবিত করার শঙ্কা রয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে অনেক প্রার্থীকে। সে কারণেই এআই নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার পক্ষেও অনেকে অভিমত দিয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী খবরের কাগজকে বলেন, 'এআই দিয়ে বানানো কনটেন্ট কৃত্রিম থাকবে। কোনটা প্রযুক্তি দিয়ে বানানো মানুষ বুঝতে ও ধরতে পারে। কোনটা ভুয়া ভিডিও, কোনটা ভুয়া বিবৃতি, এটা এখন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। এআই দিয়ে বানানো নকল কনটেন্ট ও আসল কনটেন্টের মধ্যে অনেক কিছু পার্থক্য থাকে। মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন, তাদের ভুল ইনফরমেশন দিয়ে মিসগাইড করা যাবে না।' তিনি বলেন, 'সারা বিশ্বেই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
আমাদের সত্য ও ন্যায়ের পথে সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ব্যক্তি চরিত্রহরণ ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালানোর কাজে ব্যবহার করলে সেটা মানুষ ধরে ফেলবে। তবে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সতর্ক থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

#এআই