জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে আট বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হলেও সমস্যাগুলো কাটেনি। একই সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সমস্যা।
এ সমস্যাগুলোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কিছু কিছু অবহেলার কারণে এখন ‘ইগো প্রবলেমও’ বড় হয়েছে। এ অবস্থায় এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থেকে বের হয়ে তাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি করছেন। তবে তারা স্পষ্ট করে বলছেন, কোনোভাবেই আগের মতো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তারা যাবেন না।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সরকারি কলেজগুলোকে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায় রাজধানীর সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়।
কলেজগুলো হচ্ছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। এসব কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় দুই লাখ। শিক্ষক এক হাজারের বেশি।
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সাত কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সম্পর্কের চূড়ান্ত অবসান ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।
পরে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া হয়। বৈঠক শেষে লিখিত বক্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথা জানান।
সভায় যে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা হলো-১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথকীকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে;
২. সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক বছর এগিয়ে এনে এ বছর থেকেই অর্থাৎ ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি না নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়;
৩. শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সভায় জোর সুপারিশ করা হয়;
8. ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী আসন সংখ্যা ও ভর্তি ফি নির্ধারণসহ যাবতীয় বিষয়ে মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে;
৫. যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল থাকবে, যাতে তাদের শিক্ষাজীবন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রপ্ত না হয়।
এদিকে, এই সাত কলেজের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার বিষয়টি নিয়ে সরকারও ভাবছে। গত রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। এই সাত কলেজের জন্য আলাদা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার বিষয়ে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ নিয়ে কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করেছে।
জানতে চাইলে ইউজিসির এক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বলেছেন, তারা বিভিন্ন ‘মডেল’ নিয়ে কাজ করছেন। এখনো ‘মডেল’ চূড়ান্ত হয়নি।
সাত কলেজের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার বিষয়টি নিয়ে সরকারও ভাবছে। সাত কলেজের জন্য আলাদা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার বিষয়ে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করেছে।
এ বিষয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাতটি বড় সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার পর আট বছরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্যাগুলোই পুঞ্জীভূত হয়ে বড় রূপ নিয়েছে। এই আট বছরে সমস্যাগুলো যদি ঠিকমতো সমাধান করা যেতো, তাহলে হয়তো এখনকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তবে এখন নতুন করে কিছু করার আগে ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা না হলে ভবিষ্যতে আবারও একই ধরনের সমস্যা হতে পারে।
আবার এসব কলেজের মধ্যে অধিকাংশেই উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা আছে। এর মধ্যে ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। ফলে এসব কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে, যোগ করেন তারা।
এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ গণমাধ্যমকে, সাত কলেজের বিষয়ে তারা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। এখন এটি আরো ত্বরান্বিত করবেন।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার পর তো দীর্ঘ প্রায় আট বছর হয়ে গেলো। তাহলে এই আট বছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী করলো? বাস্তবতা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশে অনুমোদিত পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৭৬টি। স্বায়ত্তশাসিত চারটিসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৬১টি (৫৫টি কার্যক্রমে আছে) এবং অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৫টি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মোট শিক্ষার্থী ৩১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি, যা দেশে উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৭২ শতাংশ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ আছে ২ হাজার ২৫৭টি। এর মধ্যে ৫৫৫টি সরকারি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট কলেজের মধ্যে ৮৮১টিতে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়।
জানা গেছে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণার জন্য বিভাগভিত্তিক গুণগত মানের শিক্ষকের অভাব আছে। আবার শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকসংকট বিরাজ করছে। কয়েক শ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৮ থেকে ৯ জন করে শিক্ষক। কিছু কলেজে বিভাগ অনুযায়ী তা আরো কম। আবার সক্ষমতার বাইরে মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়।
এদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, সেখানে আর সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়। তাই এই সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয় কবে হবে, সেই ঘোষণার আগপর্যন্ত অন্তর্বর্তী প্রশাসন দিয়ে এই সাত কলেজ চালাতে হবে, সেখানে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ থাকতে পারবেন না।