স্বপদে ফিরে আসা ও বেতন-ভাতা চালু রাখার দাবিতে শিক্ষা ভবনের সামনে মানববন্ধন করেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাঞ্ছনার শিকার ও পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শিক্ষকরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন কারণে ও সময়ে তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করা হয়। তারপর থেকেই তারা নানাভাবে স্বপদে ফেরার দাবি জানিয়ে আসছেন। শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নির্দেশে তাদের বেতন-ভাতা চালু রাখার প্রজ্ঞাপনও জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। অনিশ্চয়তায় পড়া শিক্ষকরা মঙ্গলবার শিক্ষাভবনের সামনে মানবন্ধন করেন পদ বঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষক জোটের ব্যানারে।
এ সময় তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা বেতন-ভাতা চালুর আদেশের দ্রুত বাস্তবায়ন ও জটিল পরিস্থিতি নিরসনে ৫ দফা প্রস্তাব দেন।
তারা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কিছু শিক্ষকের নাম ইএফটিতে যুক্ত করছে না একটি চক্র। এই চক্রটিই সাধারণ শিক্ষকদের জিম্মি করে রাম রাজত্ব কায়েম করেছে। তাই এই অচলায়তন শিগগিরই বন্ধ করতে হবে।
তারা আরো বলেন, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে, তহবিল তছরুপ ও লুটপাট শুরু করা হয়েছে। এখনো দেশজুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ ও হেনস্তা করার পাঁয়তারা চলছে। এ কারণে পদবঞ্চিত শিক্ষকেরা কর্মস্থলে যেতে পারছে না। তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এই দুর্দিনে মহাঅন্ধকারে পতিত হয়েছেন।
তারা বলেন, এই বর্বরতার শিকার প্রায় দুই হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন হাজার অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক। তাদের অনুপস্থিতিতে এসব স্কুল ও কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম ও শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, পরীক্ষা, খেলাধুলা ও সহশিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ স্থবিরতা চলতে পারে না। অতি দ্রুত এই অচলায়তন দূর করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সমাজের সব স্তরের মানুষের সচেতনতা দরকার।
বক্তারা আরো বলেন, আশাকরি, যথাযথ কর্তৃপক্ষ অতি শিগগিরই এ সমস্যার সুরাহা করবেন। আমরা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, প্রায় দুই হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন হাজার শিক্ষক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৪ জন মারা গেছেন। প্রায় ৫ শতজন আহত ও অসুস্থ হয়েছেন। মিথ্যা-মামলার কবলে পড়ে অনেকে জেল-হাজতে আছেন। তারা পদ-বঞ্চিত হয়ে বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। দেশজুড়ে এমন ঘটনায় বিবেকবান মানুষ বিস্মিত ও স্তম্ভিত। আপামর জনসাধারণ আতঙ্কিত ও আশাহত। আধুনিক সভ্য রাষ্ট্রে এমন ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
বিতাড়িত শিক্ষকরা আরো বলেন, দেশের সংকট মুহূর্ত থেকে প্রায় সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পদ দখল ও লুটপাট করতে সুবিধাবাদী শিক্ষক এবং স্বার্থান্বেষী দুর্বৃত্তরা অবিরাম ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এতে যেমন লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি আইন-শৃঙ্খলার বিপর্যয় ঘটছে। যেখানে শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর সেখানে আজ তারা স্বার্থলোভী সহকর্মীর হাতেই নিগৃহীত, নির্যাতিত। যে শিক্ষকেরা জীবন ভর শিশুদের আদর দিয়ে, স্নেহ দিয়ে মানুষ রূপে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আজ তারা হেনস্তার শিকার। এমন অমানবিক দৃশ্য ঘটিয়ে কিংবা দেখে কেউ সুস্থ থাকতে পারে না। অচিরেই এসব বিশৃঙ্খলাকারী শিক্ষক ও বহিরাগত দুর্বৃত্তদের অন্যায় কর্মকাণ্ড থামাতে হবে। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। নতুবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনোভাবেই সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসবে না। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে: "একটি বই, একটি কলম, একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে।"
তারা আরো বলেন, একজন শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষক কোনো ভুল বা অন্যায় করলে তার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা রয়েছে। তা দেখভাল করার জন্য কমিটি ও প্রশাসন রয়েছে। যখন দেশে উপজেলা প্রশাসন স্থবির, থানা-পুলিশ অকার্যকর। তখন স্বার্থলোভী শিক্ষকেরা আইন ও প্রশাসন অমান্য করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস থেকে বের করে ভুল বুঝিয়ে পথে নামায়। প্রতিষ্ঠান প্রধানের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করায়। এক অস্থিতিশীল ও উত্তেজনাকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাদেরকে হেনস্তা করে জোরপূর্বক পদত্যাগ, অপসারণ ও বরখাস্ত করায়।
তারা প্রশ্ন তোলেন, হেনস্তার শিকার এসব অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকের দোষ কী?
দোষ হল, তারা জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন পরিচালনা করেন। সরকারি আদেশ-নির্দেশ মেনে চলেন। নিয়ম-নীতি অনুসারে প্রতিষ্ঠান চালান। সময়মত দায়-দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেন। স্কুলের লেখাপড়ার মান যথাযথ রাখেন। অবৈধ অর্থ ভাগাভাগি না করে স্বচ্ছতা বজায় রাখেন। ফাঁকিবাজিকে প্রশ্রয় দেন না। ফলে তারা অযোগ্য, অথর্ব ও স্বার্থলিপ্সু শিক্ষকের রোষানলে পড়েছেন। আজ চিরচেনা সহকর্মীর হাতে হেনস্তার শিকার অপমানিত লজ্জিত এই শিক্ষকেরা চাকুরি হারিয়ে, বেতন না পেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই হয়রানি ও বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে তাদের অতি দ্রুত রক্ষা করতে হবে। তাদের বেতন-ভাতা চালু করতে হবে। সৎ ও নীতিবান এসব প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিরাপত্তা দিতে হবে। তাদেরকে স্বপদে বহাল করে কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা না হলে নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক করে গড়ে তোলা যাবে না।
জটিলতা নিরসনে শিক্ষকদের প্রস্তাবনাগুলো হলো- পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের এমপিও থেকে নাম কর্তন না করে বেতন-ভাতা চালু রাখার ব্যবস্থা করা। পদ-বঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ, অপসারণ, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক ছুটি বাতিল ঘোষণা করা। সসম্মানে স্বপদে বহাল করে কর্মস্থলের নিরাপত্তা বিধান করা। অনতিবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বার্থলোভী ও শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া। পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের সমমানের এমপিওভুক্ত স্কুলে শূন্যপদে বদলির ব্যবস্থা করা।