ঘন ঘন প্রাথমিকের মহাপরিচালক বদলে বিরূপ প্রভাব | বিবিধ নিউজ

ঘন ঘন প্রাথমিকের মহাপরিচালক বদলে বিরূপ প্রভাব

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরে এক বছরের মধ্যেই মহাপরিচালক পরিবর্তন করা হয়েছে চারবার। শিক্ষার বাকি অধিদপ্তরগুলোতেও প্রায় একই চিত্র। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বারবার দপ্তরের প্রধান তথা মহাপরিচালক পদে পরিবর্তনের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ব্যাহত হয় শিক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমও।

#প্রাথমিক বিদ্যালয় #উচ্চ মাধ্যমিক #সরকারি স্কুল

প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও মানোন্নয়ন, মূল্যায়ন, প্রকল্প বাস্তবায়ন, তদারকিসহ প্রায় সব কার্যক্রমই হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই দপ্তরে এক বছরের মধ্যেই মহাপরিচালক পরিবর্তন করা হয়েছে চারবার। শিক্ষার বাকি অধিদপ্তরগুলোতেও প্রায় একই চিত্র।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘন ঘন দপ্তরের প্রধান তথা মহাপরিচালক বদলের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ব্যাহত হয় শিক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমও।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নীতি ও উদ্যোগ বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে অধিদপ্তরগুলো। এছাড়া নীতিপ্রণয়নেও তারা যুক্ত থাকে। এ কারণে এসব অধিদপ্তরে মহাপরিচালক পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কতটা যথাযথ ও কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি এ ধরনের পদে স্বল্প সময়ে বারবার পরিবর্তন আনা হয় তাহলে ওই পদে থাকা ব্যক্তির পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। দেখা যায় পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে না উঠতেই তাকে বদলি করে দেয়া হচ্ছে। তাই এ ধরনের পদে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার পরিবর্তন কাম্য নয়।

বারবার পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নতুন নিযুক্ত মহাপরিচালকের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ অধ্যাপক ড. এসএম হাফিজুর রহমানের। তিনি বলেন, বিগত সময়গুলোতে আমরা এমন বেশ কয়েকজন মহাপরিচালককেই দেখেছি যারা অত্যন্ত দক্ষ ও আন্তরিক ছিলেন এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। তবে কার্যকালের সংক্ষিপ্ততার কারণে তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ২০১৯ থেকে এখন পর্যন্ত মোট সাতজন মহাপরিচালক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের মধ্যে দুজন ছাড়া বাকিদের কার্যকাল ছিল এক বছরেরও কম। আর গত এক বছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদপ্তরটির প্রধানের দায়িত্ব সামলেছেন মোহাম্মদ মিজানুর রহমান (অতিরিক্ত দায়িত্ব), মো. আব্দুস সামাদ, ড. মো. আব্দুল হাকিম ও আবু নূর মো. শামসুজ্জামান। মহাপরিচালকদের মধ্যে মো. আব্দুস সামাদ তিন মাস ও ড. মো. আব্দুল হাকিম পাঁচ মাসের মতো দায়িত্ব পালন করেন। আর বর্তমান মহাপরিচালক আবু নূর মোহাম্মদ শামসুজ্জামান পূর্ণাঙ্গভাবে এ পদে বসেছেন গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। এর আগের ছয়দিন পালন করেছেন অতিরিক্ত দায়িত্ব।

জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মহাপরিচালক হিসেবে যারা আসেন তাদের বেশির ভাগকেই চাকরির শেষ পর্যায়ে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে অবসরজনিত কারণেই তাদের কার্যকাল কম থাকে। আর বারবার মহাপরিচালক পরিবর্তনের ফলে কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। কারণ একেকজনের কাজের ধরন একেক রকম। দেখা যায় আগের মহাপরিচালক হয়তো একটা বিষয়ে একভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু নতুনজন সেটা ভিন্নভাবে ভাবছেন। এছাড়া অনেক সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যাও দেখা যায়। তাই নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য মহাপরিচালক নিয়োগ পেলে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সহজ হতো।

প্রাথমিক শিক্ষার মতো অনেকটা একই চিত্র দেখা গেছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরেও। সরকারের এ দপ্তরে গত সাত বছরে মহাপরিচালক পরিবর্তন করা হয়েছে মোট নয়বার। এর মধ্যে সর্বশেষ নিয়োগকৃত শোয়াইব আহমেদ খান ছাড়া বাকি সবাই অতিরিক্ত দায়িত্ব বা রুটিন দায়িত্ব হিসেবে পদটি সামলেছেন। তাদের কার্যকাল বিবেচনা করে দেখা যায়, সব মহাপরিচালকই দায়িত্ব পালন করেছেন এক বছরের কম সময়।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে এর আগে মহাপরিচালক পদে তুলনামূলক কম পরিবর্তন দেখা গেলেও গত এক বছরে পাল্টানো হয়েছে দুবার করে। এর মধ্যে মাউশিতে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় অধ্যাপক এহতেসাম উল হককে। তবে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট নামের একটি সংগঠনের আন্দোলনের মুখে তাকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রত্যাহার করে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। একই দিন অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খানকে নিয়োগ দেয়া হয় মাউশির প্রধান হিসেবে।

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে গত বছরের ১৫ অক্টোবর অতিরিক্ত সচিব ড. শাহনেওয়াজ দিলরুবা খানকে মহাপরিচালক পদে বসানো হয়। তবে তিন মাস পার না হতেই তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। নতুন করে অধিদপ্তরটির দায়িত্ব দেয়া হয় স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল মান্নানকে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক এক মহাপরিচালক বলেন, আমাদের নিয়োগের যেহেতু নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে না এবং আমি পূর্ণ দায়িত্বেও ছিলাম না, এ কারণে মহাপরিচালক হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারিনি। বিভিন্ন টেন্ডার কার্যক্রম থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে আমাকে কর্মকর্তাদের দাবি মেনে নিতে হয়েছে। এছাড়া কোনো পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাকে চিন্তা করতে হয়েছে এটি বাস্তবায়নযোগ্য পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারব কিনা।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো মহাপরিচালকদের ক্ষেত্রেই একটি মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও ঝুঁকি থেকে যায় যে নির্দিষ্ট মেয়াদের সুযোগে কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরির চেষ্টা করবেন কিনা। এছাড়া মাউশিতে মাঠপর্যায় থেকে কর্মকর্তাদের শীর্ষপর্যায়ে আসার সুযোগ দেখা যায়, যেটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বা অন্যান্য অধিদপ্তরে নেই। সরকারের এ বিষয়টিও পর্যালোচনা করা উচিত যে কোন সিস্টেমটি অধিক ফলপ্রসূ হচ্ছে—যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করে এসে অধিদপ্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, নাকি যারা প্রশাসন থেকে এসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন? সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বর্তমানে আমরা একটি পরিবর্তিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ সময়ে বারবার পরিবর্তনের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে যদি এভাবেই চলতে থাকে সেটি হবে বিপজ্জনক। কোনো বিষয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে, কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অবশ্যই কাজ করার জন্য সময় দিতে হবে। কিছুদিন পর পরই কর্মকর্তা পরিবর্তন হলে সেটি সম্ভব নয়।

প্রাথমিক শিক্ষায় ক্যাডার সার্ভিস না থাকা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অধিদপ্তরের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা বলে মনে করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, এখানে (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর) মাঠপর্যায় থেকে শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আসার সুযোগ নেই। বর্তমানে অধিদপ্তরে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের অধিকাংশের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা নেই এবং বিভিন্ন পরিকল্পনায় এ ঘাটতির প্রভাব দেখা যায়। কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা জরুরি। এ বিষয়টি নিয়েও সরকারের ভাবা উচিত এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা যাতে শীর্ষপর্যায়ে আসতে পারেন সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া উচিত।

#প্রাথমিক বিদ্যালয় #উচ্চ মাধ্যমিক #সরকারি স্কুল