সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের জন্য সুখবর আসছে। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বর্তমানে থাকা ‘আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা’ তুলে দেওয়া হতে পারে। এর ফলে বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকারের জন্য একটি সহায়ক ব্যবস্থা হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থাৎ কেউ যদি শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) দেন, তাহলেই তিনি সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। আগে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে আগের বছরের আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হতো, যা অনেকের জন্য ছিল কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে যেসব মানুষ করযোগ্য আয় না থাকা সত্ত্বেও রিটার্ন জমা দিতে বাধ্য হন, তাদের জন্য এটি ছিল বাড়তি ঝামেলা। নতুন নিয়ম চালু হলে তারা এসব ঝামেলা ছাড়াই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন।
সরকার আশা করছে, এই সিদ্ধান্তের ফলে মানুষ আবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে। কারণ গত এক বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলেছেন। এতে সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার কমে গেছে এবং সরকার সেখান থেকে ঋণ নিতে পারেনি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রিটার্নের শর্ত তুলে দিলে সাধারণ মানুষ আবার সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকবে।
এতে সরকার যেমন ঘাটতি পূরণে সহায়তা পাবে, তেমনি মধ্যবিত্ত ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও নির্ভরযোগ্যভাবে তাদের অর্থ সঞ্চয় করতে পারবেন। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী বাজেট বক্তৃতায় এই ঘোষণা দিতে পারেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না কারার শর্তে বলেন, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতেই সঞ্চয়পত্র ক্রয় সহজ করা হচ্ছে। কারণ এ দেশের অনেক বিধবা নারী সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল। তাদের করযোগ্য আয় না থাকার পরও রিটার্ন জমা দিতে হয়।
আবার অনেক অবসরভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী শেষ বয়সের সম্বল হিসেবে সঞ্চয়পত্রের ওপর ভরসা করেন। তাদেরও প্রতিবছর শূন্য রিটার্ন দিতে হয়। রিটার্ন জমা দিতে গিয়ে তাদের নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয়। এসব মানুষের কথা চিন্তা করে সরকার সঞ্চয়পত্র কেনা সহজ করছে।
এ দিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে প্রায় এক বছর ধরে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। উল্টো সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট বা প্রকৃত ঋণ ঋণাত্মক হয়ে গেছে।
চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে এক হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। আগের মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মকের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) নিট বিক্রি ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় আট হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়েও নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় ছিল। তবে ওই সময় এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৫০৯ কোটি টাকা।
অর্থাৎ সরকার যেখানে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ করার কথা, উল্টো মানুষ সঞ্চয়পত্র বেশি ভেঙে ফেলার কারণে সুদাসল বাবদ সরকারের ব্যয় বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রায় দেড় বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা কমেছে। উল্টো অনেকে বাড়তি খরচ সামাল দিতে সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলছেন। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের চেয়ে ব্যাংক ডিপোজিটেও ভালো মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে এখন।
সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ করে। অভ্যন্তরীণ ঋণের একটি অংশ সংগ্রহ করা হয় ব্যাংক খাত থেকে। আরেকটি বড় উৎস সঞ্চয়পত্র। তবে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কম ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ ঋণাত্মক থাকলেও অর্থবছর শেষে এই খাত থেকে সরকারের ঋণ লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি থাকবে। কারণ গত জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের সুদ বা মুনাফার হার বাড়িয়েছে সরকার। মুনাফা বৃদ্ধির পর সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কিছুটা বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।
তথ্যমতে, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে হয় তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য। মেয়াদপূর্তির আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হলে মুনাফার হার সর্বনিম্ন ৭.৭১ শতাংশ। মেয়াদ ও টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ১১.৭৬ শতাংশ মুনাফা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে যাদের এ খাতে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের মুনাফা কমে যায়।
এখন পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।
বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১.৫২ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনের সঞ্চয়পত্রে ১১.৭৬ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১.২৮ শতাংশ, তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১.৪ শতাংশ।
গত অর্থবছরের পুরো সময়ই (জুলাই-জুন) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় ছিল। ১২ মাসে আগের আসল ও সুদ বাবদ ২১ হাজার ১২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বিক্রির চেয়ে আগের সুদ-আসল বাবদ সাত হাজার ৩৫০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও সরকার এখান থেকে এক টাকাও ঋণ পায়নি। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা করেছে সরকার।