ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর মানুষের মাঝে নানা ক্ষেত্রে আশা জেগেছে। প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে পরিবর্তনের। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে আলিম ও কওমি মাদরাসার সিলেবাস পুনর্বিন্যাস, শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং আলোচনা সাপেক্ষে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের আওতাও বাড়ছে। একই সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আরও বেশি দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষার মূল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে।
সারা দেশে একটি মাত্র মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড। সরকার চাচ্ছে আরও তিন থেকে চারটি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে। মাদরাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য একমাত্র প্রতিষ্ঠান গাজীপুরের মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে আরও সম্প্রসারণ করে সেখানে একটি আধুনিক প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সাথে মাদরাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান না গড়ে সব বিভাগেই মানসম্পন্ন শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর দীর্ঘ দিন ধরেই রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভাড়া ভবনে পরিচালিত হচ্ছে। মাদরাসা অধিদপ্তরের জন্য সরকার এখন নিজস্ব জমি ও ভবনের জন্য জমি খুঁজছে। ঢাকার মিরপুরে কালশী রোডের পূর্ব দিকে (কালাপানি এলাকা) এমন একটি জমিও প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। শিগগিরই মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের নিজস্ব জমি এবং নিজস্ব ভবনে অফিস স্থানান্তরের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে।
সূত্র আরও জানায় দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার কারণে দেশের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোর অস্তিত্বই যেখানে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় ছিল সেই মাদরাসাগুলোকে জাতীয়করণ করার জন্য ইতোমধ্যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দেশের ১৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের কাজও এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। আশা করা হচ্ছে খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে এসব মাদরাসার শিক্ষকরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে বেতন ভাতাও পাবেন।অপর দিকে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত মাদরাসা পরিচালনায় সম্পৃক্ত সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বললে তারা জানান, দীর্ঘ দিন থেকেই মাদরাসা শিক্ষা নানাভাবে অবহেলিত। ইসলামী দ্বীনি শিক্ষা তথা মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে এবং এর গতিধারা সম্প্রসারণে বিগত কোনো সরকারই সঠিক কোনো পরিকল্পনা কিংবা বাস্তবতার আলোকে সঠিক কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। অভিযোগ রয়েছে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই এ দেশের মাদরাসা শিক্ষা বরাবরই ছিল উপেক্ষিত। একটি পরিসংখ্যান বলছে দেশে এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৩ হাজার ৫০০টি, সরকারি কলেজের সংখ্যা ৫৫৫টি। এ ছাড়া এখন সরকারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি। কিন্তু এর বিপরীতে সরকারি মাদরাসার সংখ্যা নেহায়েত একেবারেই কম। দেশে সরকারি আলিয়া মাদরাসার সংখ্যা মাত্র তিন। এ তিনটি হলো ঢাকা আলিয়া মাদরাসা, সিলেট আলিয়া মাদরাসা এবং বগুড়ার সরকারি মুসতাফিয়া আলিয়া মাদরাসা।
আবার শিক্ষা বোর্ডের ক্ষেত্রেও মাদরাসার জন্য রয়েছে সারা দেশব্যাপী একটি বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা। একটি মাত্র মাদরাসার শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সারা দেশের দাখিল এবং আলিম পরীক্ষার মতো বড় পরিসরের বোর্ড পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। অন্য দিকে সাধারণ শিক্ষা বোর্ড রয়েছে ৯টি। ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেটে, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। এ ছাড়া একটি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনেও শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে।মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য বৈষম্যের আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি। দেশে এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য টিচার্চ ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে ৫৩টি। সরকারি টিচার্চ ট্রেনিং কলেজ রয়েছে ১০টি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো ইসলামী শিক্ষার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূণ একটি বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (সরকারি) রয়েছে মাত্র একটি। এটিও ঢাকার বাইরে গাজীপুরে অবস্থিত। তবে আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে এবং মাদরাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে সরকার বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন শুরু হলে মাদরাসার শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক দৃশ্যমান পরিবর্তনই দেশবাসীর দৃষ্টিতে আসবে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের মাদরাসা শিক্ষার মূল ভিত্তি ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোর জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছে। দীর্ঘ দিন থেকে ঝুলে থাকা এবং অস্তিত্ব সঙ্কটে থাকা দেশের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোকে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে সরকার ইসলামী শিক্ষার প্রাথমিক স্তরকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। সূত্র মতে, বর্তমানে এসব ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা খুবই কম সম্মানীতে চাকরি করেন। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক সর্বসাকুল্যে বেতন পান মাত্র ৩৫০০ টাকা।
আর সহকারী শিক্ষকরা বেতন পান ৩২০০ টাকা। তবে জাতীয়করণের পর এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতেই বেতন পাবেন। তবে বাড়িভাড়া চিকিৎসা ভাতা কিংবা এ সংক্রান্ত কিছু অতিরিক্ত ভাতা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ীর মাদরাসার শিক্ষকরা পাবেন না। ইতোমধ্যে জেলাভিত্তিক মাদরাসা বাছাই করা হয়েছে। বাকিসব প্রক্রিয়াও দ্রুততার সাথে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।মাদরাসার শিক্ষার জন্য দেশে আরো একটি ভালো দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হতে চলছে বর্তমানের একটি মাত্র মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ভেঙে আরো তিন/চারটি শিক্ষাবোর্ড স্থাপন করা হবে। সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে অন্তত প্রতি দু’টি বিভাগের জন্য একটি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ আটটি বিভাগের জন্য চারটি মাদরাসা বোর্ড করার বিষয়ে ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা বিভাগ। সূত্র মতে, গাজীপুরের মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিবর্তে আরো সম্প্রারণ করে এবং আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত মাদরাসার শিক্ষকদের জন্য একটি জাতীয় প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠার বিষয়েও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া শুধু ঢাকায় প্রশিক্ষণের জন্য এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলে বরং বিভাগীয় পর্যায়েও যাতে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা যায় সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এতে করে দেশের সব জেলা উপজেলার মাদরাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকামুখী দৌড়াতে হবে না। বরং তাদের নিজ জেলা বা বিভাগেই উচ্চ প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি হবে।
কওমি মাদরাসাগুলোর শিক্ষার মান আরো উচ্চপর্যায়ে পৌঁছে দিতে কওমি মাদরাসার শীর্ষ আলেমদের সাথে এবং এই সেক্টরের বিশিষ্টজনদের সাথে অলোচনা ও পরামর্শ করে মাদরাসা শিক্ষাকে কিভাবে মূল ধারার শিক্ষাকাঠামোর সাথে সম্পৃক্ত করে বাস্তবধর্মী এবং আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের কিভাবে আরো দক্ষ যোগ্য হিসেবে প্রস্তুত করা যায় সে বিষয়েও জাতীয় পর্যায়ে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ করে (সম্ভাব্য তিনটি ওয়ার্কশপ) সবার সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে চলতি মাসেই (শেষ দিকে) একটি সেমিনার আয়োজনের বিষয়ে মাদরাসা বিভাগের পরিকল্পনায় রয়েছে।এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা ও কারিগরি বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম জানান, মাদরাসার দু’টি ধারাকেই (আলিয়া ও কওমি) আমরা সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করছি। মাদরাসাগুলোর শিক্ষক শূন্যতা পূরণে ইতোমধ্যে তালিকা ধরে ধরে শূন্যপদে শিক্ষকদের পদায়ন শুরু করা হয়েছে। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার জন্য যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
একই সাথে মাদরাসা শিক্ষকদের জন্যও প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আশা করছি আমাদের নেয়া পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হলে মাদরাসা শিক্ষার আমূল পরিবর্তন দেশবাসী প্রত্যক্ষ করবে।