‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি প্রকৃত অর্থেই সঠিক, মাছ ও ভাতের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক বহুকালের। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ গড়পড়তায় দিনে যে পরিমাণ মাছ খায়, বাংলাদেশের মানুষ খায় তার চেয়ে চার গুণ বেশি। বর্তমানে বাজারে মিঠাপানির যত মাছ বিক্রি হয়, তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মাছের জোগান আসে চাষ থেকে। যদিও চাষের মাছের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায়। এবার সরকারি গবেষণায়ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে। এর মধ্যে মৃগেল মাছে ক্রোমিয়াম মিলেছে নিরাপদ সীমার চেয়ে চার গুণ বেশি। অতিরিক্ত এ ক্রোমিয়াম কিডনি, যকৃৎসহ অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি করে।
চাষের মাছে ভারী ধাতুর উপস্থিতির পরিমাণ নিয়ে বছর দুয়েক আগে একটি গবেষণা প্রকাশ করেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (এফআরআই) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক। উত্তরের জেলা নাটোরের একটি বাণিজ্যিক খামারের রুই, মৃগেল, সিলভার কার্প, বাটা ও পুঁটি মাছের ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এতে মৃগেল মাছে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি নিরাপদ সীমার বেশি পাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) খাবারে কী পরিমাণ ক্রোমিয়াম মেশানো নিরাপদ তার একটি মানমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সংস্থাটি মতে, দশমিক ১৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত এর সহনীয় মাত্রা। কিন্তু এফআরআইয়ের গবেষণায় মৃগেলে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে দশমিক ৬৫৪ মিলিগ্রাম প্রতি কেজিতে, যা নিরাপদ সীমার চার গুণ। মৃগেল ছাড়া আর কোনো মাছেই ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
মৃগেল মাছে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি থাকার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নিয়ামুল নাসের বলেন, মাছটি সাধারণত নিচের দিকে কাদার মধ্যে থাকে। আর মাছ চাষের নিয়ম হলো দুই-তিন বছর পরপর পুকুরের নিচের পানি পরিষ্কার করা। চাষীরা সেটা করেন না বলেই মৃগেল মাছে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে।
বিষয়টির বাস্তবতা স্বীকার করেছেন নাটোরের মৎস্যচাষী মো. গোলাম নবী। নবীন মৎস্যচাষী বহুমুখী প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী এবং নাটোর আধুনিক মৎস্য চাষ প্রকল্প লিমিটেডের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা পুকুরগুলো সঠিক সময়ে পরিষ্কার করতে পারি না। ফলে দেখা গেছে, উচ্ছিষ্ট খাদ্য, মাছের বর্জ্য এগুলো পুকুরের নিচে গিয়ে জমা হয়। আর মৃগেল মাছ নিচে চলাচল করে। এ কারণে গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে আমরা সেটা সঠিক মনে করি।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা যায়, রুই মাছে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি দশমিক শূন্য ৩৪, মৃগেলে দশমিক শূন্য ২৬, সিলভার কার্পে দশমিক শূন্য ১৭, বাটায় দশমিক শূন্য ২৫ ও পুঁটি মাছে দশমিক শূন্য ৪৯ মিলিগ্রাম পাওয়া গেছে। আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছে রুই মাছে দশমিক শূন্য ১৫ ও সিলভার কার্পে দশমিক শূন্য ৩৩ মিলিগ্রাম। সিসা পাওয়া গিয়েছে সিলভার কার্পে দশমিক শূন্য ৫৩৪ মিলিগ্রাম। আর নিকেল পাওয়া গিয়েছে পুঁটি মাছে দশমিক শূন্য ৮ মিলিগ্রাম। গবেষকরা যেসব ধাতু খুবই সামান্য বলে উল্লেখ করেছেন, সেটা আসলে উপস্থিতি রয়েছে তবে যন্ত্রে পরিমাপযোগ্য হয়নি এমনটা বুঝিয়েছেন। যার বৈজ্ঞানিক পরিভাষা হলো বিলো ডিটেকশন লিমিট বা বিডিএল।
ক্রোমিয়াম ধাতুটি মানবদেহে অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরিতে ক্রোমিয়ামের ভূমিকা অন্যতম। অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম গ্রহণ করলে কিডনি, লিভার ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ত্বক জ্বালাপোড়া, ফুসকুড়ি, এমনকি ত্বকে প্রদাহও দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে উচ্চমাত্রার ক্রোমিয়াম গ্রহণ শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা ও স্নায়বিক সমস্যার জন্ম দিতে পারে। এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারীর ক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম গ্রহণকে মানব কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে খাবার ও পরিবেশের মধ্যে এ ধাতুর উপস্থিতি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য ইস্যু।
ক্রোমিয়ামের উপস্থিতিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটুকু তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গবেষকরা বলেন, এফএওর মানদণ্ডে যদিও মৃগেল মাছে ক্রোমিয়ামের মাত্রা চার গুণ ছাড়িয়েছে। তবে এ মাছ খেলে ক্যান্সার কিংবা অন্য রোগের ঝুঁকি তৈরি করবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ মানদণ্ড হলো ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি ১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। এ হিসেবে মৃগেল মাছ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য কোনো ঝুঁকি তৈরি করবে না।
সাধারণত নদী-খাল ও উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছে ভারী ধাতুর উপস্থিতি বেশি থাকে। এর কারণ হলো সব ধরনের বর্জ্য এখানে আসে। কিন্তু বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছে ভারী ধাতু যাওয়ার কথা নয়। যেহেতু চাষের মৃগেল মাছে এফএওর গ্রহণযোগ্য সীমা বেশি ছাড়িয়ে গিয়েছে, ব্যাপারটি ভাবনার কারণ বলে মনে করছেন অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের। তিনি বলেন, চাষের মাছে তো ভারী ধাতু থাকার কথা নয়। যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে, তার মানে এটা আমাদের জন্য সতর্কসংকেত। এ ব্যাপারে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে চাষের মাছে ভারী ধাতুর বিষয়টির জন্য ফিডও বড় দায়ী বলে মনে করেন এফআরআইয়ের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. রবিউল আউয়াল হোসেন। তার মতে, বাজারে যেসব ফিড খাওয়ানো হয় সেগুলো কতটা নিরাপদ তা নিয়ে গবেষণার সময় এসেছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মৃগেল মাছে যে পরিমাণ ক্রোমিয়াম পাওয়া গিয়েছে এটা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও আমাদের জন্য একটা সতর্কসংকেত বলতে পারি। সাবধানতার জন্য আমরা মাছের কাঁটা ও চামড়া ফেলে শুধু মাংস খেলে কোনো সমস্যা হবে না।