ছবি : দৈনিক শিক্ষাডটকম
টাকা ছাড়া এখানে কোনো কাজই হয় না। রোগীর যদি কোনো পরীক্ষা করতে হয়, টাকা দিতে হয়। এরপর হুইলচেয়ারে যদি টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে ১০০ টাকা করে দিতে হয়। টাকা নিয়েই যদি সব কাজ করে, তাহলে এটি সরকারি হাসপাতাল হলো কীভাবে? সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে স্বজনকে চিকিৎসা করাতে এসে কথাগুলো বলছিলেন আব্দুল গফুর নামে মাঝ বয়সি এক ব্যক্তি।
শুধু গফুর একা নয় জেলার অন্তত ২২ লাখ মানুষ কম-বেশি এই সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। চিকিৎসাসেবা নিতে এসে এমন অনিয়মের অভিযোগ করেন বেশিরভাগ মানুষ। অন্য ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে কমিশন বাণিজ্য, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ রোগীর কাছে বিক্রির মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।
তবে হাসপাতালের পরিচালক ডা. কুদরত-ই খোদা বলেন, ওষুধ বিক্রির বিষয়টি আমার জানা নেই। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ দিলে এই কাজ যে করেছে, তাকে আউট করে দেবো।
সম্প্রতি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রোগীকে দেয়ার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেনাবাহিনীর একটি দল। এ সময় তারা সরকারি ওষুধ বিক্রি এবং মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ড বয় হরষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
ওয়ার্ড বয় হরষিতের কাছ থেকে সরকারি ওষুধ কিনে বিপাকে পড়া সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া এলাকার মোহাম্মদ আলী বলেন, ঈদের পরদিন আমার স্ত্রীকে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাসপাতালে যোগাযোগ করলে তারা জানায়—এই ওষুধ বর্তমানে সাপ্লাই নেই, আপনি বাইরে থেকে নিয়ে আসেন। আমি প্রথম থেকেই সব ওষুধ বাইরে থেকে নিয়ে আসছি।
তিনি বলেন, হঠাৎ এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ওয়ার্ডবয় আমাকে বললো, চাচা এই ওষুধটা বাইরে থেকে কত টাকা করে কিনেছেন? আমি বললাম ৮৫০ টাকা। সে বললো, আমার কাছে ওষুধ আছে, প্রতি পিস ৫০০টাকা করে দিলে এই ওষুধ পাবেন। আমি তার কাছ থেকে ওষুধ নিয়েছি। ওষুধগুলো সরকারি।
তিনি বলেন, চারটা ওষুধ আমার স্ত্রীর শরীরে পুশ করলে সে জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করে। একপর্যায়ে জ্বর আসে। এক সময় আমার এক আত্মীয় সেগুলো দেখে আমাকে জানায়, ওষুধগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে ওষুধ বিক্রির কথা স্বীকার করে মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ডবয় হরষিত।
হরষিত বলেন, আমি ছয়-সাত মাস আগে হাসপাতালের ডাস্টবিন থেকে কয়েকটি ওষুধ কুড়িয়ে পাই। সুযোগ বুঝে এখন ওষুধগুলো বিক্রি করেছি।
এদিকে, হরষিতের কাছ থেকে ক্রয় করা ছয়টি ওষুধের অবশিষ্ট দুটি ওষুধে দেখা গেছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ চার মাস আগে থেকেই ওষুধ দুটি মেয়াদোত্তীর্ণ।
অন্যদিকে, হাসপাতালের সরকারি ওষুধ ডাস্টবিন থেকে পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শেখ আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, আমরা এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিং করেছি। হাসপাতালে ডাক্তাররা ঠিকমতো ডিউটি না করা, গাড়ির গ্যারেজে অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ করেছি। ওষুধ থাকবে হাসপাতালে স্টোরে। যেখান থেকে সুষ্ঠুভাবে রোগীর হাতে পৌঁছাবে। সেই ওষুধ কীভাবে ওয়ার্ডবয়ের মাধ্যমে বিক্রি হলো, এটা সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। শুধু ওষুধ বিক্রি নয়, হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় থেকে শুরু করে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে রয়েছে নানান ধরনের অভিযোগ। এর আগেও হাসপাতালের বাইরে বস্তা বস্তা সরকারি ওষুধ পাওয়া গিয়েছিলো। তা নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামও হয়েছিলো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
তালা উপজেলার জাতপুর এলাকা থেকে আসা রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা গরিব মানুষ, আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। পরিবারে কেউ অসুস্থ হলে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু এখানে এসে পড়তে হয় বিপাকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার প্রেশার মাপাসহ কোনো কিছু পরীক্ষা করতে বললেই দিতে হয় টাকা।
আরেক রোগীর স্বজন সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার আম্মা স্ট্রোকের রোগী। প্রথমে এসে জরুরি বিভাগে কথা বললে তারা তিন তলার মেডিসিন বিভাগে যেতে বলে। এ সময় আমরা হাসপাতালে হুইলচেয়ার ও লিফট ব্যবহার করে তিন তলায় আসি। হুইলচেয়ার ব্যবহার করে আমার আম্মাকে তিনতলায় আসামাত্রই হুইলচেয়ার বাবদ এক ওয়ার্ডবয় আমাদের কাছ থেকে টাকা নেয়। এরপর প্রেশার আর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করার সময় আবার টাকা নেয়।