প্রশ্ন হলো, এত বাজেট বরাদ্দের পরও কেন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পিছিয়ে আছে? আসুন দেখি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল সমস্যাগুলো মোটা দাগে কি কি ? এছাড়া গত ১০ বছরের বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে এর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হলে জবাবদিহিতাহীন শিক্ষা ব্যবস্থার এক ভয়াবহ চিত্র সামনে চলে আসে। রাজনীতিবীদরা এক মত না হলেও শিক্ষা খাতের ভয়াবহ চিত্রের বিষয়ে আশা করি শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা দ্বিমত করবেন না।
*শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের গত ১০ বছরের চিত্র:
গত এক দশকে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বাজেট বাড়লেও এর সঠিক বাস্তবায়ন ও ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গত ১০ বছরের শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হলো:
| অর্থবছর | মোট বাজেট (কোটি টাকা)| শিক্ষায় বরাদ্দ (কোটি টাকা) | বাজেটের শতকরা হার (%) |
|---------- |---------------------|-------------------------------------------|
| ২০১৩-১৪ | ২,২২,৪৯১ | ২৩,৬০০ | ১০.৬% |
| ২০১৪-১৫ | ২,৫০,৫০৬ | ২৬,৭০০ | ১০.৬% |
| ২০১৫-১৬ | ২,৯৫,১০০ | ৩১,৯০০ | ১০.৮% |
| ২০১৬-১৭ | ৩,৪০,৬০৫ | ৩৬,০০০ | ১০.৬% |
| ২০১৭-১৮ | ৪,০০,২৬৬ | ৪৩,৮০০ | ১০.৯% |
| ২০১৮-১৯ | ৪,৬৪,৫৭৩ | ৫৩,০০০ | ১১.৪% |
| ২০১৯-২০ | ৫,২৩,১৯০ | ৬১,০০০ | ১১.৭% |
| ২০২০-২১ | ৫,৬৮,০০০ | ৬৬,৪০০ | ১১.৭% |
| ২০২১-২২ | ৬,০৩,৬৮১ | ৭১,৯০০ | ১১.৯% |
| ২০২২-২৩ | ৬,৭৮,০৬৪ | ৮১,৪০০ | ১২.০% |
(উৎস: অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার)
তালিকা থেকে দেখা যায়, গত ১০ বছরে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রায় ৩.৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই বরাদ্দের সিংহভাগই যায় অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক নিয়োগ ও বেতন-ভাতায়। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, গবেষণা ও কারিকুলাম সংস্কারে বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে কম।
প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর পরও শিক্ষার কাঙ্খিত মান উন্নয়ন হয় না। শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বারবার কথাগুলো বললেও আমলাতান্ত্রিক ক্ষেত্রে জটিলতা এবং রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার অভাবে শিক্ষাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসে না। আন্তর্জাতিক মানতো দূরের কথা দেশের চাকরির বাজারের উপযোগী করেও শিক্ষার্থীরা গড়ে উঠতে পারে না।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মোটা দাগে কয়েকটি সমস্যা:
১. বাজেটের একটি বড় অংশ স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণ, মেরামত ও আসবাবপত্র ক্রয়েই ব্যয় হয়। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি ও খেলার মাঠ নেই। এছাড়া, গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা অপ্রতুল। এমন অবস্থার কারণ হলো অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও অদক্ষ বরাদ্দ বন্টন ব্যবস্থা।
২. শিক্ষকের অভাব ও পেশাগত দুর্বলতার চিত্র দেশজুড়ে । প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব প্রকট। অনেক শিক্ষক প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই চাকরিতে নিয়োগ পান। এছাড়া, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও পদোন্নতির ব্যবস্থা সন্তোষজনক নয়। যা তাদের মোটিভেশন কমিয়ে দেয়। শিক্ষকদেরকে শিক্ষকতার পাশাপাশি জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান বা খন্ডকালীন বিভিন্ন কাজে যুক্ত হতেও দেখা যায়। অবসর সময়ে একজন শিক্ষকের তার পাঠ্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন ছোটখাটো গবেষণা মনোযোগী না হয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য ছুটতে দেখা যায়।
৩. বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও মুখস্থনির্ভর। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলেও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এখনও গতানুগতিক। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব কম থাকায় শিক্ষার্থীরা কর্মমুখী দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। তাই এখনই সময় পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতির দুর্বলতা দূর করে কেরানী শিক্ষাকে ছুড়ে ফেলার। কেরানি শিক্ষা আর কেতাবি জ্ঞান থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে বাস্তবমুখী এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন জাতির কাছে অধরাই থেকে যাবে।
৪. করোনা মহামারীতে ডিজিটাল শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে, কিন্তু গ্রামীণ ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের কাছে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইসের সুব্যবস্থা নেই। অনেক স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব থাকলেও তা ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। তাই ডিজিটাল বিভাজন ও প্রযুক্তির অভাব দূর করতে হবে দ্রুত।
৫. শিক্ষা খাতের বাজেটের একটি অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট হয়। বই বিতরণ, ভবন নির্মাণ ও বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয় না কারণ তদারকি ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় বরাদ্দকৃত অর্থের সুষম বন্টন হয় না। তাই বন্ধ করতে হবে দুর্নীতি দুর্নীতি ও বাড়াতে হবে শিক্ষা খাতে তদারকি। ধরপাকড় করে দুর্নীতি যেমন বন্ধ করা যাবেনা তেমনি তদারকি করেও শিক্ষা খাতে পরিবর্তন শতভাগ করা যাবে না। এই জায়গায় নৈতিক শিক্ষা এবং মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করতে হবে তবেই দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাবে।
৬. বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও উদ্ভাবনী কাজের জন্য বাজেট বরাদ্দ খুবই কম। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ নগণ্য, ফলে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষকদের অর্থ বরাদ্দ দেয়া হলেও তাতে ভালো কোন গবেষণাপত্র উঠে আসেনি। এর বড় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির প্রবণতা একেবারেই কমে গেছে।
বছরের পর বছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা একই হ্যান্ডনোট বা চোতা পড়ে ডিগ্রী অর্জন করছে। এমনও নজি রয়েছে যে শিক্ষক আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তিনি ছাত্র জীবনের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে যে নোট পড়েছেন ন তা আজকের শিক্ষার্থীরাও পড়েই যাচ্ছেন। ফটোকপির দোকানগুলোতে এখনো ১০ বছর আগের কোন এক শিক্ষক বা মেধাবী ছাত্রের হ্যান্ড নোটগুলো কপি হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়ও কপি পেস্ট করে ডক্টর ডিগ্রী নেয়ার অভিযোগ ওঠে। আমাদের দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের একটি অংশ তাদের প্রমোশন বা ইনক্রিমেন্টের জন্য গবেষণাপত্রগুলোকে একটি অবলম্বন মনে করেন মাত্র।
হতাশার কথা বলতেই আমরা যেন জাতি হিসেবে বেশি উৎসই। আমাদের পত্রপত্রিকা আবার টেলিভিশনগুলোতে শুধু সমালোচনায় দেখা যায়। বিশেষ করে টেলিভিশন টকশোগুলোতে যেন একেকটি সমস্যার ভান্ডার খোলা হয়। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যার পাশাপাশি কিছু ছোট ছোট উদ্যোগ বা সমাধানের কথাও বলতে চাই।
১. অবকাঠামোর পাশাপাশি শিক্ষক প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও কারিকুলাম উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষার মান উন্নয়নে নিশ্চিত করতে হবে বাজেটের সুষম বণ্টন।
২. মেধাবী ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি তাদের জন্য নিয়মিত ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু একটি হলরুম ভাড়া নিয়ে দুই একটি সেশনের নামে সময় কাটিয়ে দিলেই হবে না। সময় শেষে সবার হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিয়ে বাজেট শেষ করার ওয়ার্কশপ নয়। নিশ্চিত করতে হবে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের উপযোগ্য সময়োপযোগী কিছু বিষয় শিক্ষকদের মগজে পৌঁছে দেয়া গেলো কি না।
৩. বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে আরও কারিগরি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারও আগে বিদ্যমান কারিগরি স্কুল কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে গুণগতমান সম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
একটু সচেতন ভাবে রক্ষা করলেই দেখা যাবে এখনো বিদেশের মাটিতে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা ব্যাপক। প্রতিবেশী দেশ দক্ষ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ শুধুমাত্র শ্রমিক পাঠাতে পারে। বিদেশের শ্রমিক পাঠানোর মানসিকতা পরিবর্তন করে দক্ষ জনের শক্তি রপ্তানি করা হলে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশী মুদ্রার পরিমাণ বাড়বে।
৪. পুঁথিগত বিদ্যা বা কেরানি শিক্ষার অভিশাপ মাথায় নিয়েই বেড়ে উঠছে আমাদের কয়েকটি প্রজন্ম। চীন যেখানে ১০জি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে সেখানে আমাদের দেশে থ্রিজি ফাইভজির নামে প্রতারিত হচ্ছি আমরা। আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সঠিক প্রযুক্তির ব্যবহার তো দূরের কথা সংযোগেই পাচ্ছি না।
বাসা বাড়ি স্কুল কলেজ বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এখনো ইন্টারনেট সেবার নামে চলে ভয়াবহ প্রতারণা। ১০,২০এমবিপিএস বা ৪০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেটের নামে ৫ এমবিবিএস পাওয়াই দূরূহ। তাই প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সঠিক গতির ইন্টারনেট সংযোগ ও আধুনিক ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করতে হবে ।
৫. সর্বপরি তদারকি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা খাতের বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে তৃতীয় পক্ষের মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা এখন সময়ের প্রয়োজন। মোটামুটি এতটুকু বলতে পারি
বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি শিক্ষার উন্নতির জন্য অপরিহার্য, কিন্তু শুধু অর্থ বাড়ালেই সমস্যার সমাধান হয় না। প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা। সরকার, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট সকলকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তবেই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে পারবে।
লেখক: আবু সাঈদ, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।