পৃথিবীর স্বর্গ নামে পরিচিত কাশ্মীর উপত্যকা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মনোরম দৃশ্য এবং উর্বর ভূমির জন্য বিখ্যাত। তবে এই ভূখণ্ডটি ১৯৪৭ সাল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই বিরোধের কারণে দুটি দেশ বহুবার সংঘাতে জড়িয়েছে এবং আজও এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সাম্প্রতি ‘স্বর্গে’ সন্ত্রাসী হামলার পর আবার আলোচনায় কাশ্মীর।
কাশ্মীরের মালিকানা: ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর কোনো একক দেশের অংশ ছিল না। এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজবংশ এবং সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর, ভারতীয় উপমহাদেশ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়–ভারত ও পাকিস্তান।
দেশ ভাগের সময়, কাশ্মীর ছিল একটি স্বাধীন দেশীয় রাজ্য। যার শাসক ছিলেন হিন্দু মহারাজা হরি সিং এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা ছিল মুসলিম।
দেশভাগের নীতি অনুযায়ী, দেশীয় রাজ্যগুলোর অধিকার ছিল ভারত বা পাকিস্তানের সাথে যোগ দেওয়া অথবা স্বাধীন থাকার। মহারাজা হরি সিং প্রথমে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। তবে,১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানপন্থী উপজাতিদের আক্রমণের মুখে তিনি ভারতের সাহায্য চান।
বিতর্কিতভাবে 'ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেসন' (Instrument of Accession) চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীরের ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্তির সম্মতি দেন। পাকিস্তান এই অন্তর্ভুক্তিকে অবৈধ বলে মনে করে।
হরি সিংর চুক্তিটি কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলে দাবি করে পাকিস্তান। তাদের যুক্তি, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত ছিল।
আরো পড়ুন : ১. ’সিন্ধুর’ পানি ছাড়লো কেন ভারত?
২.‘স্বর্গে’ সন্ত্রাসী হামলা: নিরাপত্তাহীনতায় কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা
কার দখলে কতটুকু এলাকা:বর্তমানে কাশ্মীর বিভিন্ন অংশে বিভক্ত এবং তিনটি দেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে:
ভারত: জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকা, লাদাখ এবং সিয়াচেন হিমবাহসহ প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকা ভারতের নিয়ন্ত্রণে। ভারত এই অঞ্চলটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করেছে – জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ।
পাকিস্তান: আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বালতিস্তানসহ প্রায় ৩৭ শতাংশ এলাকা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পাকিস্তান এই অঞ্চলটিকে দুটি পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করেছে।
চীন: আকসাই চীনসহ মাত্র ১০ শতাংশ এলাকা চীনের নিয়ন্ত্রণে। যা ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর থেকে তাদের দখলে। পাকিস্তান ১৯৬৩ সালে ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট নামে একটি ছোট অংশ চীনকে হস্তান্তর করে।
কাশ্মীরের অর্থনৈতিক সম্পদ ও সম্ভাবনা: কাশ্মীরের অর্থনীতি মূলত কৃষি, পর্যটন এবং হস্তশিল্পের উপর নির্ভরশীল।
কৃষি: কাশ্মীর তার উর্বর মাটি এবং অনুকূল জলবায়ুর জন্য পরিচিত। এখানকার প্রধান কৃষি পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে ধান, ভুট্টা, গম, বার্লি, আপেল, নাশপাতি, চেরি, এপ্রিকট এবং জাফরান। জাফরান উৎপাদনে কাশ্মীর বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত এবং এটি একটি মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ।
পর্যটন: কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একে 'প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড' বা 'পৃথিবীর স্বর্গ' নামে পরিচিত করেছে। গ্রীষ্মকালে মনোরম উপত্যকা, শীতকালে বরফাচ্ছাদিত পর্বতমালা সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। পর্যটন এখানকার অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জঙ্গি কার্যকলাপ প্রায়শই এই খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
হস্তশিল্প: কাশ্মীর তার শাল, পশমিনা, কাঠের কাজ এবং কার্পেটের জন্য বিখ্যাত। এই হস্তশিল্পগুলি অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ চাহিদা রাখে এবং বহু মানুষের জীবিকার উৎস।
জলবিদ্যুৎ: কাশ্মীরে বেশ কিছু নদ-নদী রয়েছে, যা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা তৈরি করে।
এছাড়াও, এই অঞ্চলে খনিজ সম্পদেরও সম্ভাবনা রয়েছে অনেক। যদিও এখনও তার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করা হয়নি। স্থিতিশীলতা ফিরে এলে কাশ্মীর একটি সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হতে পারে।
মালিকানা বিরোধে দুই দেশের সংঘাত:কাশ্মীরের মালিকানা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার সরাসরি সংঘাতে জড়িয়েছে:
প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৪৭-৪৮): মহারাজার ভারতের সাথে যোগদানের পর এই যুদ্ধ শুরু হয়। দুই দেশের প্রথম যুদ্ধটি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয়। এর ফলস্বরূপ কাশ্মীর দুটি অংশে বিভক্ত হয়।
দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৬৫): কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধ শুরু হয় এবং উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
কার্গিল যুদ্ধ (১৯৯৯): নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের ভারতীয় ভূখণ্ড দখলের চেষ্টার ফলে এই সংঘাত হয় এবং ভারত এতে বিজয়ী হয়।
এছাড়াও, উভয় দেশের মধ্যে নিয়মিত সীমান্ত সংঘর্ষ, গোলাগুলি এবং জঙ্গি হামলা লেগেই থাকে, যা পরিস্থিতিকে সর্বদা উত্তপ্ত রাখে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্থায়ী সমাধানের অভাব: কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্য বহুবার আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা ও মধ্যস্থতার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে কোনো স্থায়ী সমাধান আজও বের হয়নি। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
উভয় পক্ষের অনড় অবস্থান: ভারত কাশ্মীরকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে । তারা কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ মানতে নারাজ। অন্যদিকে, পাকিস্তান কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী গণভোটের দাবি জানায় তারা।
জাতিসংঘের প্রস্তাব: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীরে গণভোটের মাধ্যমে সেখানকার জনগণের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য একাধিক প্রস্তাব পাস করেছে। তবে, ভারত এই প্রস্তাবগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করে। কারণ তাদের দাবি কাশ্মীর ইতিমধ্যেই তাদের অংশ।
সন্ত্রাসবাদ: পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর কাশ্মীরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ভারতের উদ্বেগের একটি বড় কারণ। ভারত পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ করে।
ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা: কাশ্মীর সমস্যা আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চীনও এই অঞ্চলের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই তাদের স্বার্থও এই বিরোধের সাথে জড়িত।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাধারণত উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর এবং আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানায়। তবে, কোনো সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকরী সমাধান সূত্র এখনও পাওয়া যায়নি।
ইতিহাসবিদ ও আন্তর্জাতিক সীমানা আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত:
ঐতিহাসিকদের মতামত: ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি একটি জটিল এবং বিতর্কিত বিষয় ছিল। মহারাজার সিদ্ধান্ত এবং তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই বিরোধের জন্ম দিয়েছে। তারা আরও মনে করেন, কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক সীমানা আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত: আন্তর্জাতিক সীমানা আইন বিশেষজ্ঞরা 'ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেসন' চুক্তির বৈধতা এবং কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের উপর জোর দেন। তাদের মতে, জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো এখনও প্রাসঙ্গিক।
আরো পড়ুন: ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ কী হবে?
একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য উভয় পক্ষের নমনীয়তা এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানো জরুরি। তারা মনে করেন, একটি গণভোট বা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাশ্মীরিদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা উচিত। তবে, এর বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন, কারণ ভারত এটিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধ একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীরভাবে প্রোথিত সমস্যা। 'পৃথিবীর স্বর্গ' খ্যাত এই ভূখণ্ডটি আজ রক্তক্ষয়ী সংঘাত এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, মালিকানা বিরোধের কারণে এই অঞ্চলের মানুষজন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে।
আন্তর্জাতিক স্তরে বহু চেষ্টা করেও এর কোনো স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ উভয় দেশই তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। পুরো দক্ষিণ এশিয় অশান্ত হতে পারে শুধুমাত্র ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ নিয়ে।
তাই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং মানবিক করনে হলেও একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উভয় দেশকে নমনীয় হতে হবে। কাশ্মীরিদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়েপৌঁছাতে হবে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে।