মানবিক করিডোর কতটুকু ঝুঁকির পথ | মতামত নিউজ

মানবিক করিডোর কতটুকু ঝুঁকির পথ

মানবিক করিডোর মূলত তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়: বেসামরিক নাগরিকদের স্থানান্তর; মানবিক সহায়তা সরবরাহ;    আহত ও অসুস্থদের চিকিৎসা;তবে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশের রাখাইন অঞ্চলের মানবিক করিডোর কোন উদ্দেশ্যে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

#মতামত #রোহিঙ্গা #সামরিক

দুটি দেশের মধ্য দিয়ে মানবিক করিডোর বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা পথ। যা যুদ্ধ বা সংঘাত কবলিত এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ চলাচল এবং মানবিক সহায়তা প্রবেশের জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সম্মতির ভিত্তিতে তৈরি করা হয়।

এটি মূলত একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে খাদ্য, চিকিৎসা সামগ্রী এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া যায়।

আটকে পড়া মানুষ, আহত বা অসুস্থদের সরিয়ে আনা সম্ভব হয়। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী, বিপদগ্রস্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো এবং তাদের নিরাপদে সরিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, এবং মানবিক করিডোর সেই উদ্দেশ্য পূরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

মানবিক করিডোর মূলত তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়:

বেসামরিক নাগরিকদের স্থানান্তর: যুদ্ধ বা সংঘাতের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থসহ সাধারণ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা।

মানবিক সহায়তা সরবরাহ: খাদ্য, জল, ঔষধ, বস্ত্র এবং অন্যান্য জরুরি ত্রাণসামগ্রী সংঘাত কবলিত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

আহত ও অসুস্থদের চিকিৎসা: আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা এবং অসুস্থদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া।তবে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশের রাখাইন অঞ্চলের মানবিক করিডোর কোন উদ্দেশ্যে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

বিশ্বের কয়েকটি দেশে মানবিক করিডোর: বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতময় অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে মানবিক করিডোর স্থাপন করা হয়েছে। এর কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কিন্ডারট্রান্সপোর্ট: নাৎসি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে প্রায় ১০ হাজার ইহুদি শিশুকে যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

বসনিয়ার যুদ্ধ (১৯৯২-১৯৯৫): জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় 'নিরাপদ এলাকা' তৈরি করা হয়েছিল, যা মানবিক করিডোরের মতো কাজ করেছিল।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ: এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া এবং ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে মানবিক করিডোর স্থাপন ও ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে প্রায়শই তা ভঙ্গ হয়েছে বা কার্যকর হয়নি।

ইথিওপিয়ার টাইগ্রে সংঘাত: এখানেও খাদ্য ও ত্রাণ সরবরাহের জন্য মানবিক করিডোর তৈরি করা হয়েছিল, যদিও পরবর্তীতে তা সংঘর্ষের কারণে বন্ধ হয়ে যায়।

লিবিয়া: আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM) এবং অন্যান্য সংস্থা লিবিয়ায় আটকে পড়া অভিবাসীদের নিরাপদে সরিয়ে আনার জন্য মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে, যার মাধ্যমে কিছু সংখ্যক মানুষকে ইতালি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ (২০২২-বর্তমান): রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সংঘাতে মারিউপোল এবং অন্যান্য শহর থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রচেষ্টা দেখা গেছে, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা সফল হয়নি এবং হামলার শিকার হয়েছে।

গাজা: ইসরায়েল-হামাস সংঘাতেও গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ এবং বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য করিডোরের আলোচনা হয়েছে, তবে বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন।

সম্প্রতি, সাইপ্রাস এবং গাজার মধ্যে একটি সমুদ্র পথে মানবিক করিডোর চালুর ঘোষণা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো যাবে।

মানবিক করিডোর চালু করে বিপদে পড়া দেশ: মানবিক করিডোর চালু করার সিদ্ধান্ত সাধারণত কোনো দেশকে সরাসরি বিপদে ফেলে না। বরং, এটি একটি সংকট মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে, কিছু পরোক্ষ ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জ অবশ্যই থাকে:

নিরাপত্তার অভাব: যদি করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায়, তবে বেসামরিক নাগরিক এবং ত্রাণকর্মীরা উভয়ই হামলার শিকার হতে পারে। ইউক্রেন এবং সিরিয়ার মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে এমন ঘটনা ঘটেছে।

বিশ্বাসঘাতকতা: সংঘাতের পক্ষগুলো অনেক সময় মানবিক করিডোরের শর্ত ভঙ্গ করে। যার ফলে করিডোরটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

সামরিক সুবিধা: কোনো পক্ষ কৌশলগত কারণে মানবিক করিডোর ব্যবহার করে সামরিক সরঞ্জাম বা তাদের সৈন্যদের সাধারণ মানুষের পরিচয়ে স্থানান্তর করতে পারে। যা করিডোরের নিরপেক্ষতা নষ্ট করে এবং এটিকে হামলার লক্ষবস্তুতে পরিণত করতে পারে।

জনসংখ্যার স্থানান্তর: কোনো কোনো ক্ষেত্রে, মানবিক করিডোর ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনসংখ্যাকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠ। যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে এমন আশঙ্কা রয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদী নির্ভরতা: দীর্ঘ সময় ধরে মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরতা স্থানীয় অর্থনীতি এবং মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, মানবিক করিডোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও এর বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সততা, সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাই এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পারে।

কোনো দেশ সরাসরি মানবিক করিডোর চালু করে বিপদে না পড়লেও, এর অপব্যবহার বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

মো: আবু সাঈদ; লেখক:ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ।

#মতামত #রোহিঙ্গা #সামরিক