পাকিস্তান ভারতের রাফাল ধ্বংস করেছে এমন দাবি জোড়ালো ভাবেই করছে। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে রাফাল ধ্বংসের কথা স্বীকার করা হচ্ছে না।
কিন্তু এত কিছু থাকতে রাফাল কেন আলোচনায়? দাসোর এই ‘ আকাশ দানব’ সম্পর্কে দৈনিক শিক্ষার পাঠকদের জন্য কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো।
সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক শক্তির কথা আসলেই আকাশ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সামনে চলে আসে। সেই আলোচনায় অবশ্যই প্রথম দিকের আসন দখল করে ‘রাফাল’। এটি আসলে কি?
একটি যুদ্ধ বিমান? এতটুকুই? যুদ্ধ বিমান তো কতোই আছে। তাহলে রাফাল নিয়ে কেন এত ফালাফালি।
আসলে একে শুধু একটি যুদ্ধ বিমান বলে থেমে থাকা সঠিক হবে না। ফ্রান্সের দাসো এভিয়েশনের এই যুদ্ধ বিমান মূলত শত্রুর বিরুদ্ধে শূণ্যে থাকা এক সাক্ষাত ‘দানব’!
কার কাছে কত রাফাল আছে?
ফ্রান্সের বিমান বাহিনীতে ১০২টি এবং নৌবাহিনীতে ৪২টি রাফাল যুদ্ধবিমান রয়েছে। মিশরীয় বিমান বাহিনীতে ২৪টি রাফাল যুদ্ধবিমান রয়েছে এবং কাতার বিমান বাহিনীতে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান রয়েছে।
ভারত ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের সাথে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই ৩৬টি বিমান বর্তমানে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যুক্ত রয়েছে। এছাড়া, ভারত সম্প্রতি তাদের নৌবাহিনীর জন্য ফ্রান্সের কাছ থেকে আরও ২৬টি রাফাল-এম যুদ্ধবিমান কেনার জন্য একটি চুক্তি করেছে। এই বিমানগুলো ২০৩১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সরবরাহ করা হবে ।
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে চুক্তির পর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ভারত প্রথম ধাপে পাঁচটি। তারপর ধাপে ধাপে মোট ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করে। রাফাল হাতে পাওয়ার পর ভারতীয় বিমান বাহিনীর ক্ষমতা ও শক্তি অনেকটাই বেড়ে যাবে।
দুই ইঞ্জিনের মিডিয়াম মাল্টি রোল কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট গোত্রের এই যুদ্ধবিমানে রয়েছে এমন সব অত্যাধুনিক ক্ষমতা ও প্রযুক্তি যাতে শত্রুপক্ষকে সহজেই টেক্কা দেওয়া যায়। নিশানায় যেমন নিখুঁত ও দ্রুত, তেমনই একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করতে পারবে।
ফরাসি এই যুদ্ধবিমানের গতিবেগ ঘণ্টায় ২ হাজার ২২২ কিলোমিটার। ৫০ হাজার ফিট পর্যন্ত উপরে উঠতে পারে।
তবে স্বচ্ছন্দে উড়তে পারে মাটি থেকে ৩৭০০ কিলোমিটার উপরে। মাঝ আকাশেই জ্বালানি ভর্তি করার ব্যবস্থাও রয়েছে। যেকোনও আবহাওয়ায় সমান স্বচ্ছন্দ রাফাল যুদ্ধবিমান।
রাফালে দৈর্ঘ্য ১৫ দশমিক ২৭ মিটার। প্রতিটি ডানার দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৮ মিটার। সুখোইয়ের চেয়েও বেশি ওজন বহন করতে পারে রাফাল। সুখোইয়ের বহন ক্ষমতা ৮০০০ কিলোগ্রাম। রাফাল সেখানে ৯ হাজার ৫০০ কেজি ওজন নিয়ে উড়তে সক্ষম।
রাফালের রয়েছে ‘ডেল্টা উইং। গ্রিক বর্ণ ‘ডেল্টা’থেকে এই নামের উৎপত্তি। যার আকৃতি অনেকটা ত্রিভূজের মতো। অত্যাধুনিক অধিকাংশ যুদ্ধবিমানেই এই ডেল্টা উইং থাকে। যা দ্রুতগতিতে উড়তে সাহায্য করে।
ফরাসি সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থা দাসো এভিয়েশনের তৈরি এই যুদ্ধবিমানে ইঞ্জিনের এমন ক্ষমতা যে, ‘কমব্যাট মোড’থেকে স্থির অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগে মাত্র ৩ সেকেন্ড।
রাফাল যুদ্ধবিমান পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম। শুধু তাই নয়, প্রায় সব ধরনের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে উড়তে পারে এবং নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে পারে।
নেক্সট জেন প্রযুক্তির আকাশ থেকে আকাশ মাইকা, দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশ মেটিওর, দূরপাল্লার স্কাল্প, যুদ্ধজাহাজ বিধ্বংসী এএম ৩৯ এক্সোসেট-এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে রাফাল যুদ্ধবিমান।
স্কাল্প ক্ষেপণাস্ত্র স্থির লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে পারে। আর মাইকা ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের অদৃশ্য বস্তুতেও হামলা চালানো যায়।
ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও বিভিন্ন প্রকৃতির লেজার নির্দেশিত বোমা, অনির্দেশিত ক্লাসিক বোমাও ফেলা যায় এই যুদ্ধবিমান থেকে। রাফাল থেকে ছোড়া যায় নেক্সটর ৩০এম৭৯১৩০ ইন্টারনাল কামান। এই কামান প্রতি মিনিটে ২৫০০ রাউন্ড গোলাবর্ষণ করতে পারে।
শুধু আক্রমণ শানানো নয়, যেকোনও যুদ্ধে শত্রুপক্ষের থেকে কৌশলগত দিক থেকে এগিয়ে থাকতেও রাফালের জুড়ি মেলা ভার। আকাশ সুরক্ষা, ক্লোজ এয়ার সাপোর্ট, ইনডেপথ স্ট্রাইক, নজরদারি, জাহাজ বিধ্বংসী আঘাত হানার ক্ষমতা এবং সর্বোপরি পারমাণবিক অস্ত্র বহন করার ক্ষমতাই রাফালকে অন্য প্রায় সব যুদ্ধবিমানের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে রেখেছে।
আকাশযুদ্ধে ‘এয়ার সুপ্রিমেসি’অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিপক্ষের যুদ্ধবিমানকে সব দিক দিয়ে টেক্কা দিয়ে গোটা আকাশসীমায় আধিপত্য কায়েম করাকে কৌশলগত পরিভাষায় এয়ার সুপ্রিম্যাসি বলা হয়। আর এক্ষেত্রেও রাফালের বিকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ইন্টারডিকশন বা ডিপ এয়ার সাপোর্ট দিতে এই ফরাসি যুদ্ধবিমান অত্যন্ত দক্ষ। যে ভূখণ্ডে আকাশপথে হামলা চালানো হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই সেই ভূখণ্ড শত্রুপক্ষের দখলে থাকে। ফলে মাটির খুব কাছাকাছি পৌঁছে হামলা চালানো যায় না। অনেক উঁচু থেকে শত্রুর ঘাঁটি ধ্বংস করতে হয়। রাফাল অনায়াসেই সেই কাজ করতে পারে।
দুই পদাতিক বাহিনীর যুদ্ধের সময় মাটির কাছাকাছি এসে শত্রুপক্ষের উপর হামলা চালাতে যে রাফাল পারদর্শী, তার প্রমাণও মিলেছে ইতিমধ্যেই।
যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ সেনার অবস্থান ও প্রকৃতি বুঝতে পারলেই কোথায় হামলা চালানো হবে, কীভাবে হবে- সেই সব কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। এই রণকৌশলেও রাফাল সুদক্ষ। আকাশে অনেক দূর থেকেও শত্রুপক্ষের সেনা ঘাঁটি ও সমর সরঞ্জামের নিখুঁত ছবি তুলে পাঠাতে পারে।
এর পাশাপাশি শত্রুপক্ষের রাডার জ্যাম করতে পারে। জল, স্থল হোক বা আকাশ— তিন ক্ষেত্রেই শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করতে পারে। পারে নিখুঁত নিশানায় আঘাত করতে।
এই সব সাধারণ প্রযুক্তি তো রয়েছেই, তার সঙ্গে ভারতের জন্য আবার নির্দিষ্ট করে কিছু বৈশিষ্ট যুক্ত হয়েছে রাফালে। তার মধ্যে অন্যতম উচ্চ অক্ষাংশ থেকে আকাশে ওড়ার ক্ষমতা। লেহর ভারতীয় বিমান বাহিনীর ঘাঁটির কথা মাথায় রেখেই অতিরিক্ত এই বৈশিষ্ট্য যোগ হয়েছে ভারতের রাফালগুলোতে।
শুরুর দিকে একটি রাফাল উৎপাদনে সময় লাগতো ২৪ মাস। এখন মাসে তিনটি ও আগামী দিনগুলোতে প্রতি মাসে ৪টি রাফাল উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বলে জানান উৎপাদনকারী কোম্পানীটির প্রধান নির্বাহী এরিক ট্র্যাপিয়ার।