ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনা শুধু এই দুটি দেশের জন্যই নয়। তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর উপরও সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে।
ভারত পাকিস্তানের সম্ভব্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেলে বাণিজ্যে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটবে। কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানি ব্যাহত হবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে শিল্প এবং অর্থনীতির উপর।
যেমন, বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম উল্লেখ করেছেন যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ আমদানি ও রপ্তানি ব্যাহত হবে।
আঞ্চলিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে দ্বিধা বোধ করবেন। যা প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে চরম ভাবে।
এছাড়াও পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় যে প্রভাব পড়বে তাতে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পাবে।সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। বাংলাদেশের স্টক মার্কেটে ইতিমধ্যেই এর প্রভাব দেখা গেছে। যেখানে ডিএসই সূচকের বড় পতন হয়েছে।
যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষজন বাস্তুচ্যুত হতে পারে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরনার্থি হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে পারেন সীমান্তের মানুষরা।
যা ঐ দেশগুলোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর চাপ সৃষ্টি করবে।
বাড়তে পারে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। ভারত পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ সাম্প্রদায়িক বিভেদ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
যার প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরও পড়তে পারে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উভয় দেশেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনা ঘটবে তাতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগের কারণ হবে।
রাজনৈতিক প্রভাব:
ভারত ও পাকিস্তানের সম্ভাব্য যুদ্ধ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোকেও তাদের পররাষ্ট্রনীতি পুনর্বিবেচনা করতে হতে পারে।
যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন দেশের মধ্যে জোট ও সমীকরণে পরিবর্তন আসতে পারে। কিছু দেশ হয়তো কোনো একটি পক্ষকে সমর্থন করবে, আবার কিছু দেশ নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়তে পারে। জনমত কোনো একটি দেশের পক্ষে বা বিপক্ষে যেতে পারে, যা সরকারের নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশে যেমন ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্ট একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সমর বিশারদদের মতামত, আন্তর্জাতিক মহল থেকে উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর এবং উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং অন্যান্য বিশ্ব নেতারা সামরিক সংঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপর জোর দিয়েছেন।
অনেক সমর বিশারদ মনে করেন যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ কারো জন্যই লাভজনক হবে না। উভয় দেশই পারমানবিক শক্তিধর হওয়ায় সংঘাত মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ইয়ান হল এবং ডঃ প্রদীপ তানেজা মনে করেন, উভয় দেশই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে চাইবে। কারণ এর অর্থনৈতিক পরিণতি উভয়ের জন্যই ভয়াবহ হবে।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভারতের সম্প্রতি নেয়া পদক্ষেপ, যেমন সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করা, আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এটিকে "জল সন্ত্রাসবাদ" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, কিছু ভারতীয় সমর বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে পাকিস্তানের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য ছিল। তারা মনে করেন, ভারত তার আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ মঞ্জরী চ্যাটার্জি মিলার মনে করেন, এই সংঘাতের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের উপর একটি কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার এই সংঘাত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুধু তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং উভয় দেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে উত্তেজনা প্রশমন করে আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা।