ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফের একবার চরম উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে যুদ্ধের দামামা বাজার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
ভারতীয় নাগরিকদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে, এমন খবরও প্রচারিত হচ্ছে। দেশজুড়ে মগ ড্রিল এবং সামরিক শক্তির প্রদর্শন এই আবহাওয়াকে আরও ঘোরালো করে তুলেছে।
এই পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সকলের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে – ঠিক কী কারণে এই যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?
দীর্ঘদিনের বিবাদমান ভূখণ্ড কাশ্মীর নিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, নাকি পাকিস্তানের মাটি থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলের উদ্দেশ্য–আসল কারণ কোনটি?
বিশ্লেষকরা এই পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন? আসুন, এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বহু পুরনো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে উভয় দেশ একাধিকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। কাশ্মীর উপত্যকা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হওয়ায় একে ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ নামেও অভিহিত করা হয়।
এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ বরাবরই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের প্রধান কারণ। ভারত মনে করে সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীর তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে পাকিস্তান কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে কথা বলে।
অন্যদিকে, জঙ্গিবাদ একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা জিইয়ে রেখেছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে পাকিস্তান তাদের মাটিতে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং তারা ভারতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর জন্য মদদ যোগাচ্ছে।
মুম্বাই হামলা, পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে হামলা এবং পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার মতো একাধিক ঘটনায় ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের দিকে সরাসরি অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে। ভারত বরাবরই পাকিস্তানের কাছে জঙ্গিবাদ বন্ধের দাবি জানিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, যুদ্ধের প্রস্তুতির যে খবর সামনে আসছে, তার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। কাশ্মীর ইস্যু এখনও একটি জ্বলন্ত সমস্যা। ২০১৯ সালে ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও বিষয়টি নিয়ে সরব হয় তারা। এই পরিস্থিতিতে, কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
আবার, জঙ্গিবাদ নির্মূলের বিষয়টিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকার বরাবরই পাকিস্তানের উপর জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে আসছে।
সাম্প্রতিককালে, ভারতের পক্ষ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গি ঘাঁটিতে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ এবং ‘এয়ার স্ট্রাইক’-এর মতো পদক্ষেপ দেখা গেছে।
যুদ্ধের প্রস্তুতির এই আবহে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে ভারত পাকিস্তানের মাটিতে জঙ্গি ঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে আরও বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে।
তবে, শুধুমাত্র এই দুটি কারণই কি যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করেছে? অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এর পেছনে আরও কিছু কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মধ্যে এই পরিস্থিতি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভারত হয়তো পাকিস্তানের উপর দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ করতে চাইছে এবং একটি সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও কাশ্মীর সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করতে চাইছে।
তাদের মতে, ভারতের সামরিক শক্তি আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা ভারতের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে।
অন্যদিকে, অনেক বিশ্লেষক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সম্ভাবনাকে কম বলে মনে করছেন। তাদের মতে, উভয় দেশই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র এবং একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ উভয় পক্ষের জন্যই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
আন্তর্জাতিক মহলও এই ধরনের সংঘাত এড়াতে জোরালো পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করা যায়। তাদের মতে, বর্তমানের সামরিক প্রস্তুতি এবং শক্তি প্রদর্শন সম্ভবত পাকিস্তানকে চাপে রাখার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি কৌশল হতে পারে।
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভারত হয়তো একটি সীমিত আকারের সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানকে একটি কঠোর বার্তা দিতে চাইছে। যাতে তারা তাদের মাটি থেকে জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ করে। কাশ্মীর নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়। মগ ড্রিল এবং শক্তি প্রদর্শন সেই কৌশলেরই অংশ হতে পারে। যার মাধ্যমে ভারতীয় জনমতকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে এবং পাকিস্তানকে একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপের মধ্যে রাখা হচ্ছে।
তবে, যুদ্ধের কারণ যাই হোক না কেন, এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে। উভয় দেশের সাধারণ মানুষ, অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। উন্নয়নমূলক কাজ ব্যাহত হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা উভয় পক্ষকে সংযম বজায় রাখার এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার আহ্বান জানিয়েছেন। বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও এই সংঘাত এড়াতে কূটনৈতিক স্তরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
ভারতের বিশাল সৈন্যবাহিনী আর কৌশলের সাথে পেরে উঠতে না পারলে পাকিস্তান পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে তা হবে চরম মানবিক বিপর্যয়। কারণ দেশেটির অভ্যন্তরিন রাজনীতি যেমন দুর্বল তেমনি অর্থনৈতিক শক্তিও বেশ নড়বড়ে।
অপর দিকে ভারতের জাতীয় বাজেটে সামরিক খাতে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি ডলারের বরাদ্দ রাখা হয়। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিরোধ যাই থাকুক জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে ভারতীয় রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা সব বিভেদ ও বিদ্বেষ ভুলে ঐক্যের পতাকা তলে চলে আসেন। যা দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর জন্য একটি বড় শক্তি।
পরিশেষে বলা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমানের চরম উত্তেজনা একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং শক্তি প্রদর্শনের খবর জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তবে, এই পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে গড়াবে কি-না, তা সময়ই বলবে।
বিশ্লেষকরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করছেন, তবে কেউই নিশ্চিতভাবে যুদ্ধের কারণ বা পরিণতি সম্পর্কে কিছু বলতে পারছেন না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, উভয় পক্ষকে সংযম দেখাতে হবে এবং আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
অন্যথায়, এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি একটি ভয়াবহ সংঘাতের জন্ম দিতে পারে, যার ফলস্বরূপ উভয় দেশের অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে।
লেখক: মো: আবু সাঈদ; ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।